ভাতহীন পৃথিবী!

ভাতহীন পৃথিবী!

সুদীপ পাকড়াশি
Posted on ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

চাল এই পৃথিবীর অজস্র গুরুত্বপূর্ণ বস্তুদের মধ্যে অন্যতম। কতটা অপরিহার্য সেটা নেচার ক্লাইমেট ম্যাগাজিন না জানালে সাধারণ মানুষের কান পর্যন্ত হয়ত পৌঁছত না! মার্কিন যুক্তরাষ্টের এই জনপ্রিয় ম্যাগাজিন একটি সাম্প্রতিক লেখায় জানিয়েছে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। শুধু ‘ভেতো বাঙালি’ মানে আমাদের গর্বিত হওয়ার কারণ নেই। আমাদের চেয়েও অনেক বেশি ‘ভেতো’ চিন! পৃথিবীর সর্বোচ্চ চাল প্রস্তুতকারক এই দেশ বছরে চাল উৎপাদন করে ২১৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। উৎপাদনের পরিমাণে এরপর একে একে লাইনে আসবে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ আর ভিয়েতনাম। এশিয়া থেকে চোখ সরিয়ে আফ্রিকার দিকে তাকান। নাইজেরিয়ায় চাল উৎপাদন হয় বছরে ৬.৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন। গোটা আফ্রিকায়, না খেতে পাওয়া দেশগুলোর মানুষও সারাদিনে তাকিয়ে থাকে একটু চালের দিকে, যাতে ফুটিয়েও খেয়ে নেওয়া যায়। ব্রাজিলে চাল উৎপাদনের পরিমাণ বছরে ১১.৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন। আমেরিকায় বছরে ১০.২ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
কিন্তু এই পরিসংখ্যান নিয়ে কী করবেন পিটার রিস্ট্রম?
তিনি একজন কৃষক। চার প্রজন্ম ধরে যে পরিবারের পেশা ধান চাষ করা এবং চাল উৎপাদন করা। ক্যালিফোর্ণিয়ার সাক্রামেন্তো উপত্যকায় রুক্ষ হয়ে পড়া মাটির ওপর দিয়ে হাঁটছিলেন পিটার। হতাশা এবং আতঙ্কে। প্রায় একবছর হয়ে গেল, চাল উৎপন্ন হচ্ছে না। চাষ করতে পারেননি! খরার মত অবস্থা পুরো অঞ্চল জুড়ে! বৃষ্টি নেই, নদীগুলো শুকিয়ে কাঠ, ক্যালিফোর্ণিয়ায় যে বরফের পাহাড়গুলো রয়েছে সেখানে বরফ জমতে পারছে না! সারাবছরের গড় তাপমাত্রা যে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে গিয়েছে! সৌজন্যে বিশ্ব উষ্ণায়ন।
ক্যালিফোর্ণিয়ার ৯৫ শতাংশ চাল উৎপন্ন হয় সাক্রামেন্তো উপত্যকায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চাল উৎপাদনকারী রাজ্যের নাম ক্যালিফোর্ণিয়া। গতবছর থেকে সেই সাক্রামেন্তো উপত্যকায় ধান চাষ বন্ধ! মাটি শুকিয়ে কাঠ! নেচার ক্লাইমেট ম্যাগাজিন জানিয়ে দিয়েছে, পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়নে চালহীন হয়ে পড়ছে অর্ধেক পৃথিবী! পিটার বলেছেন, “ধান থেকে চাল হওয়ার জন্য উষ্ণতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রক্রিয়ার মাঝপথে উষ্ণতা যদি ৩৫ ডিগ্রি বা তার বেশি থাকে তাহলে তো সেই ধান গাছটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই হচ্ছে গতবছর থেকে।” বিশ্ব উষ্ণায়ন কতটা ক্ষতি করছে সেটাও পিটার বলেছেন, “২০২০-তে প্রবল দাবদাহে চাষের এই অবস্থা হল। ২০১৭ আর ২০১৯-এ এমন বৃষ্টি হল যে বন্যা হয়ে জমিতে পোঁতা সমস্ত বীজ নষ্ট হয়ে গেল। বন্যার জল সরার পর জমিতে এত কাদা আর পলি যে ট্র্যাক্টর চালানোর উপায় ছিল না।”
ভারত, বাংলাদেশ, চিন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া-সমস্ত দেশে ছবিটা একরকম। বিজ্ঞানীরা, ইঞ্জিনিয়াররা সারা বছর যাতে চাষ করা যায়, তার পৃথিবী জুড়ে জন্য জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করছেন। হচ্ছেও সেই কাজ। কিন্তু উষ্ণায়ন যেভাবে বাড়ছে, বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, জমা জলে আর্সেনিক ঢুকে পড়ছে, প্রবেশ করছে নানারকমের ব্যাকটিরিয়া। তারপর, উষ্ণায়নের জন্য হঠাৎ হঠাৎ কিছু দেশে অপ্রত্যাশিতভাবে অত্যাধিক বৃষ্টি হচ্ছে সেটাও ধান চাষের পক্ষে ক্ষতিকর বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। তাঁদের মতে ১০ সেন্টিমিটার জল ধান চাষের পক্ষে উপযুক্ত। কিন্তু অত্যাধিক বৃষ্টির ফলে জমিতে জলের স্তর বেড়ে গেলে ধান গাছের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু গবেষকদের মতে ভিয়েতনামের মত দেশে, যেখানে উপকূল জুড়ে ডেল্টার অবস্থান, সেখানে আরও একটি ভয় নুন জল! যাতে ধান চাষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এর সমাধান কী? বিশ্ব জুড়ে গবেষণা চলছে অবিরাম। ফিলিপিন্সের লাগুনা দে বে-তে তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক রাইস জিন ব্যাঙ্ক। সেখানে রাখা আছে ১ লক্ষ ৩২ হাজার রকমের চালের জিন! পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি করা হয়েছে, সোনার মত দেখতে ‘সোনার চাল’! তৈরি করা হয়েছে ‘স্কুবা চাল’! সাব-১ নামের এক জিন থেকে। ১৯৯৬-এ ওড়িষায় যে জিনের আবিষ্কার হয়েছিল! এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের পেছনের উদ্দেশ্য একটাই, বিশ্বের উষ্ণায়নকে আদৌ কমানো বা বন্ধ করা যাবে কি না জানা যাচ্ছে না। সেই অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে না থেকে বরং চাল উৎপাদনের বিষয়টা নিশ্চিত করা যাক। না হলে তো একদিন পৃথিবী ভাতহীন হয়ে পড়বে!