ভারতীয় বায়ুদূষণ সূচকের সীমাবদ্ধতা  

ভারতীয় বায়ুদূষণ সূচকের সীমাবদ্ধতা  

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৬ নভেম্বর, ২০২৫

উত্তর ভারতে নভেম্বর মানেই কুয়াশাচ্ছন্ন ধূসর ধোঁয়াটে আকাশ। বাতাসে মিশে থাকে পোড়া গন্ধ, আর ঘরের বাইরে পা রাখা মানেই চোখে-মুখে জ্বালা বা স্বাস্থ্য ভেদে দম আটকে আসা। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মানুষের মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায় -আজ বাতাসের গুনমানাঙ্ক কত, মানে আজ বাতাস কতটা বিষাক্ত ? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে মানুষ কোথাকার তথ্যের ওপর নজর রাখছে তার ওপরে। ভারতের সরকারি অ্যাপ অনুযায়ী এ কিউ আই / বায়ুর গুনগত মানের সর্বোচ্চ সীমা ৫০০, কিন্তু আন্তর্জাতিক বা ব্যক্তিগত মনিটর – যেমন, আই কিউ এয়ার বা ওপেন-সোর্স এ কিউ আই নেটওয়ার্ক অনেক সময় ৬০০, ৭০০ এমনকি ১,০০০-এরও উপর দূষণের মাত্রা দেখায়।

একটু আধটু নয়, ফারাকটা বেশ অনেকটা মাত্রার। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে – আগেও বহুবার উঠেছে – তাহলে আসল অবস্থা কোনটা? মানুষ কোন মানটা বিশ্বাস করবে? আর দূষণের মাত্রা যদি বেশি হয়, তাহলে সরকারিভাবে ৫০০-র উপরের মাত্রা কেন দেখানো হয় না?

জাতীয় বায়ুর গুণমান সূচক তৈরি হয় প্রায় এক দশকেরও কিছু বেশি সময় আগে। সেসময় বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল—এ কিউ আই ৫০০তে পৌঁছানো মানে পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক যে তার পরের স্তর আলাদা করে উল্লেখ করার আর প্রয়োজন নেই। স্বাস্থ্যহানির মাত্রাও তখন সর্বোচ্চই ধরে নেওয়া হয়েছিল। একইসঙ্গে আমজনতার মধ্যে অযথা আতঙ্ক তৈরি না করার বিষয়টিও বিবেচনায় ছিল। সমস্যা হলো, এই নির্ধারিত সীমা বাস্তবতাকে একপ্রকার ধামাচাপা দিচ্ছে। ফলে, ৫০০-এর ওপরে ৫১০, ৭০০ কিংবা ১,০০০ দূষণের মাত্রা যতই বাড়ুক, সরকারি স্ক্রিনে তা সবসময় ‘সিভিয়ার’/ ‘গুরুতর’ বিভাগেই আটকে যায়। ফলে প্রকৃত অবস্থার গভীরতা জনগণের কাছে স্পষ্ট হয় না, এবং জরুরি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অস্পষ্ট থেকে যায়। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, ৫০০-র ওপর দূষণ যত বাড়ে, শরীরের ক্ষতিও তত মারাত্মক হয়। ফুসফুস থেকে শুরু করে হৃদযন্ত্র, এমনকি মস্তিষ্কও এর প্রভাব থেকে রক্ষা পায় না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে কোনো বাধ্যবাধকতামূলক ঊর্ধসীমা নেই। এ কারণেই তাদের তথ্য বাস্তব মাত্রাকে আরও স্বচ্ছভাবে তুলে ধরে।

শুধু তাই নয়, দূষণ -মাত্রা নির্দেশকের ক্ষেত্রেও রয়ে গেছে বিস্তর ফারাক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ২৪ ঘণ্টায় PM2.5 মাত্রা ১৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটারের ওপরে গেলেই স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। কিন্তু ভারতে সেই সীমা ৬০ মাইক্রোগ্রাম, অর্থাৎ চারগুণ বেশি। ফলে ডাব্লিউ এইচ ও বা যুক্তরাষ্ট্রের এ কিউ আই -এর সঙ্গে ভারতীয় এ কিউ আই তুলনা করলে বিভ্রান্তিকর তো হবেই।

এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত পার্থক্যর ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বি এ এম (বিটা অ্যাটেনুয়েশন মনিটর) ব্যবহার করে, যা কণার প্রকৃত ভর মাপতে উপযোগী। অন্যদিকে আই আর -এর মতো প্ল্যাটফর্ম সেন্সর-ভিত্তিক ডিভাইস ব্যবহার করে আই কিউ এ, যা দ্রুততার সাথে লেজারের মাধ্যমে কণা অনুমান করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সেন্সরগুলো এখনও সরকারি ব্যবস্থায় অনুমোদিত নয় এবং মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেই কারণে দুই ধরনের তথ্যের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০০৯ সালের পর ভারতের বায়ুমান সূচকের কাঠামোর বড় কোনো সংস্কার হয়নি। বর্তমান প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য-গবেষণার ভিত্তিতে এ কিউ আই পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি। সবচেয়ে বড় বিষয় হল, সরকারি স্কেল থেকে ৫০০-র এই সীমা সরিয়ে প্রকৃত দূষণ মাত্রা দেখানো একান্তই দরকার। কারণ ইতিমধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহযোগিতায় আমরা জেনে গেছি, দূষণ মাত্রার সাথে সমানুপাতিক হারে স্বাস্থ্যের ক্ষতিও বৃদ্ধি পায়।

সত্য এটাই যে ভারতের সরকারি এ কিউ আই স্কেল ৫০০ তে থেমে থাকলেও বায়ুদূষণ সেই বাধা মানে না।

 

সূত্র : Why India caps pollution reading at 500 when the air is far more toxic by Nikita Yadav BBC News, Delhi, (16/11/2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × five =