ভাষা বৈচিত্র্য ও জীববৈচিত্র্যের পরম্পরা সম্বন্ধ

ভাষা বৈচিত্র্য ও জীববৈচিত্র্যের পরম্পরা সম্বন্ধ

শিবাংশু মুখোপাধ্যায়
Posted on ১৪ আগষ্ট, ২০২১

দ্বিতীয় কিস্তি

[ভাষার বৈচিত্র্যের ও জীববৈচিত্র্যের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্দ। কোনো জনজাতি বিপন্ন বা অবলুপ্ত হয়ে গেলে যেমন জীববৈচিত্র্যের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ে, তেমনই কোনো প্রজাতি বিপন্ন হলে মানুষের জীবনেও তার প্রভাব পড়ে। আজ দ্বিতীয় কিস্তি]

মানব-কৌমের মধ্যে বৈচিত্র্যকে মানুষের জৈব কাণ্ডকারখানার মধ্যেই ধরা হয়। একইভাবে, ভাষার বৈচিত্র্যকে – জৈব অভিযোজনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতির যে নমনীয় জায়গা সেই ধারাগুলোর সঙ্গে ওতোপ্রত হতে হতে তৈরি হওয়া বিভিন্ন কৌম হিসেবে ধরা হয়। সেই কারণে, ভাষা বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে জৈব ঘটনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি। সেখানে বংশগতি ও ভাষার সংগঠনকে পাশাপাশি রেখেও দেখার চেষ্টা করা হয়, কারণ ওই দুটো জিনিসই সমান্তরালভাবে বিবর্তিত হয়েছে। এই বিষয়ের গবেষকরা এই যে ভাষা বৈচিত্র্য ও জীববৈচিত্র্যের মধ্যে পারম্পর্যের যে সম্পর্ক – তাকে পৃথিবীর ৭০% ভাষার ক্ষেত্রেই সত্য বলে মনে করেন। এমনিতে প্রজাতির বৈচিত্র্য আর ভাষার বৈচিত্র্যের মধ্যেকার সম্বন্ধের হিসেব প্রথমত আঞ্চলিক-প্রকৃতি-নির্ভর, দ্বিতীয়ত সেই হিসেব কষা বেশ জটিলও বটে। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, সারা পৃথিবীর মাত্র ৬.১% অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যের উচ্চ হার লক্ষ্য করা গেছে। যে আনুপুঙ্খ বিচার তাঁরা করেছেন, তাতে প্রধানত ভাষাকে দেখা হয়েছে প্রাকৃতিক ও জৈবিক শব্দের ভান্ডার হিসেবে, যেমন; পরিবেশ, গাছপালা, প্রাণীজীবন, ইত্যাদি। তার ওপর, আমার কাজে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে যে, যে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে ফলাফল পাওয়া গেছে, অর্থাৎ অরণ্য অধ্যুষিত অঞ্চলে ভাষা বৈচিত্র্যের হার বেশি – সেই কাজের ফলশ্রুতি হিসেবে নতুন নতুন কাজ শুরু হবে এই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। কারণ এই কাজের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই অনেকে মিলে একসঙ্গে উপলব্ধি করবেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন এ-দেশে তেমন কেউ এগিয়ে আসেন নি এখনও।

নিউ গিনির ওপর একটা গবেষণায় এও দেখা গেছে যে বিপন্ন ভাষা এবং বিপন্ন স্তন্যপায়ীর মধ্যে ঋণাত্মক পারম্পর্য (নিগেটিভ কোরিলেশন) রয়েছে। আমার এই ছোট্ট গবেষণা পত্রেও ভাষা বৈচিত্র্য এবং জীববৈচিত্র্যের মধ্যে পারম্পর্য দেখানো হয়েছে কিন্তু একটু অন্য কৌশলে। এবং সেই কৌশলে দেখা গেছে রাজ্যের মোট জনসংখ্যার তুলনায় অন্যান্য ভাষার সংখ্যার যে হার সেই হারের সঙ্গে রাজ্যের মোট আয়তনের তুলনায় অরণ্য অধ্যুষিত অঞ্চল বা বনানীর হার – এই দুই চলের মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী ধনাত্মক পারম্পর্য রয়েছে। এবং সেই ফলের অবশ্যম্ভাবী তাৎপর্য ভাষা বৈচিত্র্য ও জীববৈচিত্র্যের মধ্যেকার সম্বন্ধ। কিন্তু কেন ওই দুই চলরাশিকে (রাজ্যের মোট জনসংখ্যার তুলনায় অন্যান্য ভাষার জনসংখ্যার হার এবং রাজ্যের মোট আয়তনের তুলনায় অরণ্য অধ্যুষিত অঞ্চল বা বনানীর হার) এই সম্বন্ধের হিসেবের জন্য বেছে নেওয়া হল তার একটা যুৎসই ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার।

২০১১ সালে, উত্তরদাতার প্রতি বিশ্বস্ত (ফেইথফুল টু দ্য রেসপনডেন্ট) থাকা – এই সূত্রের ওপর নির্ভর করে ভারতীয় আদমসুমারী রিপোর্ট দিয়েছিল ভারতবর্ষে ১৯৫৬৯-টা মাতৃভাষার খবর পাওয়া গেছে। সেই কাঁচা অসংবদ্ধ তথ্যের ওপর নিয়মনিবদ্ধ যুক্তিনিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক জরিপের (এডিট অ্যান্ড র‍্যাশনালাইজেশন) পর সেই মাতৃভাষার পরিসংখ্যান স্থির হয়েছে – ভারতবর্ষে যুক্তিনিষ্ট মাতৃভাষার (র‍্যাশনালাইজড মাদার টাঙ) সংখ্যা ১৩৬৯ এবং অযৌক্তিক অথচ ভাষীর সংখ্যা অনেক এবং যাথারীতি শ্রেণিভুক্ত নয় (আনক্লাসিফায়েড) এমন মাতৃভাষার সংখ্যা ১৪৭৪। এছাড়া, ১০,০০০-এর ওপর বক্তা আছে এমন ভাষার সংখ্যা ১২১। এই ১২১ ভাষার মধ্যে ২২-টা তালিকাভুক্ত হয়েছে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তপঃসিলে – তার মানে আমি যে ভাষাগুলোর কথা এই রচনায় বিবেচনা করেছি তার সংখ্যা ৯৯।

ওই ২২-টা ভাষার জনসংখ্যা ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার ৯৬.৭১%। সেখানে অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত ভাষা অর্থাৎ ১৩৬৯ – ২২ = ১৩৪৭-টা ভাষা ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩.২৯%। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে, ভারত সরকারের পরিসংখ্যান ধরে নিলেও, ওই ৩.২৯% মানুষের মধ্যে কী ব্যাপক ভাষিক বৈচিত্র্য। সেই কারণে, আমি যখন রাজ্যস্তরে ওই অন্যান্য অথচ শ্রেণিভুক্ত ভাষার বক্তাদের দিকে তাকাচ্ছি তখন আমি আসলে ওই রাজ্যের ভাষা-বৈচিত্র্যের দিকে তাকাচ্ছি। (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 1 =