
গঙ্গার গ্রীষ্মকালীন প্রবাহ বজায় রাখে প্রধানত ভূগর্ভস্থ জল, হিমবাহের গলিত জল নয় — এমনটাই উঠে এসেছে আইআইটি রুরকি পরিচালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আইসোটোপ গবেষণা থেকে। এই গবেষণায় গঙ্গার জলের মূল উৎস হিসেবে ভূগর্ভস্থ জলাধার বা অ্যাকুইফার-কে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গবেষণাপত্রর প্রধান লেখক এবং আইআইটি রুরকির ভূ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অভয়ানন্দ সিং মোর্য বলেছেন এই গবেষণার সবচেয়ে বড় বার্তাগুলোর একটি হলো, গঙ্গা নদী ভূগর্ভস্থ জল নিঃশেষ হওয়ার কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে না, শুকাচ্ছে অতিরিক্ত জল তোলা, অপ্রয়োজনীয় জলবিভাজন এবং উপনদীগুলোর প্রতি অবহেলার কারণে।
তিনি আরও জানান, ভূগর্ভস্থ জলই গঙ্গার অদৃশ্য জীবনরেখা। পূর্ববর্তী অনেক গবেষণায় উপগ্রহচিত্রের উপর ভিত্তি করে হিমবাহ গলন ও বরফকে গঙ্গার প্রধান উৎস ধরা হতো, কিন্তু এই নতুন গবেষণায় সেই ধারণা খণ্ডন করা হয়েছে।
এই গবেষণা ২৯ জুলাই, “হাইড্রোলজিক্যাল প্রোসেসেস” নামক এক আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয়েছে, হিমবাহ গলনের প্রভাব গঙ্গার জলের প্রবাহে খুবই সামান্য। হিমালয়ের পাদদেশ অতিক্রম করার পর থেকে এই গলিত বরফের ভূমিকা প্রায় নগণ্য।
গবেষণায় গঙ্গার উৎপত্তি স্থান (হিমালয়) থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরে মোহনা পর্যন্ত এর প্রধান প্রধান উপনদীগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ আইসোটোপ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
আইসোটোপ বিশ্লেষণে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের অনুপাত পর্যালোচনা করে জলের উৎস, গতি এবং নদীর সঙ্গে এর আন্তঃক্রিয়া বোঝা যায়।
দেখা গেছে, মধ্য গাঙ্গেয় সমতলভূমি (প্রায় ১২০০ কিমি দীর্ঘ) কৃষি ও শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । সেখানেই নদী ও ভূগর্ভস্থ জলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া ঘটে। এই অংশে ভূগর্ভস্থ জল নদীর জলপ্রবাহকে প্রায় ১২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।
বিশ বছর ধরে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গঙ্গার মধ্যভাগে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর স্থিতিশীল রয়েছে। কাজেই নদীর গ্রীষ্মকালীন প্রবাহ হ্রাসের প্রধান কারণ মানুষের কার্যকলাপ, ভূগর্ভস্থ জল নিঃশেষ হওয়া নয়।
আইআইটি রুরকির পরিচালক কে. কে. পন্ত বলেন, “এই গবেষণা ভারতের অন্যান্য নদীগুলোর প্রবাহ ও গতিপ্রকৃতি বোঝার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হবে। এ থেকে পাওয়া শিক্ষা নীতি-নির্ধারকদের আরও কার্যকরভাবে নদী পুনরুজ্জীবনের পথ নির্ধারণে সাহায্য করবে।”
তিনি আরও বলেন, গঙ্গার প্রবাহকে স্বাভাবিক রাখার জন্য আমাদের ভূগর্ভস্থ জলাধার রক্ষা ও নতুন করে ভরাট করতে হবে। এটি অন্যান্য নদীগুলোর ভবিষ্যৎও নির্ধারণ করবে।
পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যসচিব এবং সেচ বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সচিব করন বীর সিং সিধু এক পোস্টে বলেন, “এই গবেষণা প্রমাণ করে যে বিভিন্ন গঙ্গা প্রকল্পগুলোকে ভূগর্ভস্থ জলাধার নতুন করে ভরাট করা, সেচ নিয়ন্ত্রণ, জলাভূমি পুনরুজ্জীবন ও উপনদী পুনরুদ্ধারের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। শুধুমাত্র নদীর উপরিভাগ পরিষ্কার করাই যথেষ্ট নয়।“
এই গবেষণা আমাদের জলনীতি ও নদী পুনরুজ্জীবন কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে, যদি সরকার ও সমাজ যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়। নাহলে অপেক্ষা করছে শুষ্ক নদী ও ভেঙে পড়া জলভান্ডারের করুণ ভবিষ্যৎ। গঙ্গা নদী শুধু একটি ভৌগোলিক রূপরেখা নয়, এটি ভারতীয় সভ্যতার নাড়ির স্পন্দন। এর সুরক্ষা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা আমাদের নৈতিক ও পরিবেশগত দায়িত্ব।
সূত্র: Hydrological Dynamics in Giant Tropical Rivers: A Case Study of the Ganga River by Amzad Hussain Laskar, P. Saranya, et.al ; Hydrological Processes(Vol 39/Issue 7) (29th July, 2025).