ভূমিকম্প বা বড় ধসের পর ধ্বংসস্তূপের নীচে আটকে পড়া মানুষের কাছে পৌঁছানোই উদ্ধারকর্মীদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভাঙা কংক্রিটের ফাঁক, সরু গলি আর অস্থির পরিবেশে বড় ড্রোন প্রায়ই অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই সমস্যার সমাধানে বহুদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা ক্ষুদ্র উড়ন্ত রোবটের কথা ভাবছিলেন। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত কোনো মাইক্রোরোবট প্রকৃত পোকামাকড়ের মতো দ্রুত, চটপটে ও সাহসী উড়ান দেখাতে পারেনি।
এই সীমাবদ্ধতাকেই ভেঙে যুক্তরাষ্ট্রের এম আই টি (ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি)-এর গবেষকরা তৈরি করেন এক নতুন মাইক্রোরোবট। আকারে একটি অতি ক্ষুদ্র ক্যাসেটের সমান এবং ওজনে একটি পেপারক্লিপের থেকেও হালকা। এই রোবটটি অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ভ্রমরের মতো উড়তে, মোচড় দিতে এবং দ্রুত গতি পরিবর্তন করতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই মাইক্রোরোবটটি মাত্র ১১ সেকেন্ডে টানা ১০টি ডিগবাজির কৌশল সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। এমনকি প্রবল বাতাসের ধাক্কা সামলেও নিজের গতিপথ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আগের সংস্করণের তুলনায় এর গতি বেড়েছে প্রায় ৪৫০ শতাংশ, আর ত্বরণ বেড়েছে প্রায় ২৫০ শতাংশ।
এম আই টি-এর অধ্যাপক কেভিন চেনের মতে, লক্ষ্য ছিল এমন এক রোবট তৈরি করা যা সেই সব জায়গায় পৌঁছাতে পারবে, যেখানে সাধারণ কোয়াডকপ্টার ড্রোন ব্যর্থ হয়, কিন্তু পোকামাকড় অনায়াসে ঢুকে পড়ে। তাঁর ভাষায়, নতুন বায়ো-অনুপ্রাণিত কন্ট্রোল ফ্রেমওয়ার্ক এই রোবটকে গতি, ত্বরণ ও দেহের ঝোঁকের ক্ষেত্রে প্রকৃত পোকামাকড়ের সমতুল্য করে তুলেছে।
এই সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে রোবটের নতুন কন্ট্রোল সিস্টেমের। আগে রোবটের কন্ট্রোলার হাতে-কলমে টিউন করা হতো, যা তার ক্ষমতা সীমিত করত। এবার গবেষকেরা ব্যবহার করেছেন মডেল-প্রেডিকটিভ কন্ট্রোলার, যা আগাম হিসেব করে জটিল উড়ান কৌশল পরিকল্পনা করতে পারে—যেমন হঠাৎ বাঁক খাওয়া, দ্রুত উল্টে যাওয়া ।
তবে এইসব জটিল হিসেব ছোট রোবটের পক্ষে সরাসরি চালানো সম্ভব নয়। তাই গবেষকেরা এই পরিকল্পনাকারী কন্ট্রোলারকে ব্যবহার করে ইমিটেশন লার্নিং-এর মাধ্যমে একটি ডিপ-লার্নিং মডেল প্রশিক্ষণ দেন। এর ফলে রোবটটি ভারী গণনার প্রয়োজন ছাড়াই মুহূর্তের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, রোবটটি দ্রুত গতিতেও মাত্র ৫ সেন্টিমিটারের মধ্যে নিজের নির্ধারিত পথ বজায় রাখতে পারে। এমনকি এটি পোকামাকড়ের মতো হঠাৎ ঝাঁপিয়ে এগিয়ে থেমে যাওয়ার কৌশল নিখুঁতভাবে অনুকরণ করেছে, যা ভবিষ্যতে ক্যামেরা ও সেন্সর স্থাপনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষকদের আশা, ভবিষ্যতে সেন্সর ও ক্যামেরা যুক্ত হলে এই মাইক্রোরোবটগুলো বাস্তব পরিবেশে স্বাধীনভাবে উড়তে পারবে এবং দলগতভাবে কাজ করতেও শিখবে। প্রকৃতির কাছ থেকে শেখা এই প্রযুক্তি একদিন ধ্বংসস্তূপের নীচে আটকে থাকা মানুষের জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে—ভ্রমরের মতোই দ্রুত, সাহসী আর নির্ভুলভাবে।
সূত্রঃ Aerobatic maneuvers in insect-scale flapping-wing aerial robots via deep-learned robust tube model predictive control by Yi-Hsuan Hsiao, Suhan Kim, et.al; published in the journal Science Advances, 3rd December 2025.
DOI: 10.1126/sciadv.aea8716
