ভয়ঙ্কর সুন্দর

ভয়ঙ্কর সুন্দর

সুপ্রতিম চৌধুরী
Posted on ২৩ অক্টোবর, ২০২১

নিজের ডিঙি-নৌকোটা সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে বিকেল বিকেল রওনা দিল মধ্যবয়স্ক জেলেটি। গতকাল রাত থেকেই তার মন উসখুস করছে। সন্ধেবেলা বন্ধুদের কাছে সে এক নতুন গল্প শুনেছে। তা গল্প না বাস্তব, সেটা নিজের চোখেই দেখা যাবে আজ।
জেলেটির বাস ব্রেজিলের সাও পাওলোর উপকূলবর্তী এক গ্রামে। শোনা কথা, সমুদ্র ধরে মাইল বিশেক দক্ষিণে নাকি এক দ্বীপ আছে। সেখানে নাকি বহুকাল আগে জলদস্যুদের আনাগোনা ছিল। তারা তাদের লুঠের হীরে-জহরত ওখানেই লুকিয়ে রেখে আসত। কিন্তু কোম্পানির লোকেরা যাতে সেখানে হানা দিয়ে ধনরত্ন বাজেয়াপ্ত করতে না পারে, সেই কারণে তারা নিজেদের গুপ্তধন সেই দ্বীপে এক ভয়ঙ্কর বিভীষিকার কাছে গচ্ছিত রেখে গেছে। যদি কোন লোভী ব্যক্তি সেখানে অনুপ্রবেশ করে, সেই পাহারাদার তাকে হত্যা করে। ভয়ে কেউ ওদিকে ভুলেও যায় না।
সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এক সময় জেলেটি বুঝল, বন্ধুদের গল্পটা নিছক বাজে কথা নয়। তার সামনে জঙ্গলে ঢাকা এক সুবিশাল, পাথুরে দ্বীপ অতলান্তিকের গভীর থেকে সত্যিই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশে এখন কালো মেঘ ঘনীভূত হয়েছে। এই ধূসর পরিবেশে ঘন সবুজ দ্বীপটির শোভা যেন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে জেলেটি আরেকটু এগিয়ে দ্বীপের একধারে ডিঙিটা ভেড়াল। বৃষ্টি শুরু হয়েছে টিপটিপ করে।
দ্বীপের কিছুটা ভিতর অবধি গিয়েও মনের মত কিছুই পাওয়া গেল না – এক ওই সারি সারি কলাগাছ ছাড়া। পশুপাখিও এদিকে একদমই নেই। কিছু পরিযায়ী পাখি মাঝেমাঝে আসে – এই যা। চারদিক আশ্চর্যরকম থমথমে। এদিকে বৃষ্টির তেজ বাড়তেই, সমগ্র বনাঞ্চলকে অন্ধকার গ্রাস করল। এই এক বিড়ম্বনা। বেরোনোর সময়ও বেশ রোদ ছিল। কিন্তু রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ যে এভাবে হঠাৎ গোঁসা করবে তা কে জানত! জেলেটি বুঝল দ্বীপেই রাত কাটাতে হবে। দিনের আলো ফুটলে আবার ভাল করে ঘুরে দেখা যাবে।
কলা দিয়ে নৈশভোজ সম্পন্ন করে সে একটা বড় গাছ দেখে তার গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসল। আচমকা কাছের একটা ডাল থেকে কিছু একটা নিচে পড়ল। আরেক দিকে ঘাসের উপর একটা সড়সড় শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গোড়ালির কাছে একটা কামড়। তার সঙ্গে ভীষণ যন্ত্রণা।
সাপ!
জেলেটি ভয়ে উঠে পড়ে পড়িমরি পাড়ের দিকে ছুটতে লাগল। কিন্তু ছুটতে যেতেই অন্য পায়ে আবার কামড়। সে ছোটা থামাল না। কোনোমতে নিজের ডিঙিতে পৌঁছতেই হবে। এই অভিশপ্ত দ্বীপে আর এক মুহূর্ত থাকা যাবে না। দুই পায়ে মুহুর্মুহু আঘাত হেনে চলেছে অদৃশ্য শত্রু।
কিছুটা গিয়েই জেলেটি মুখ থুবড়ে পড়ল। তার গোটা শরীর একবার কেঁপে উঠেই থেমে গেল। তার দেহ থেকে অবিরত রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে। সেই রক্তে পড়ে রইল তার নিথর দেহ।
বস্তাপচা ‘হরর স্টোরি’ ভাবছেন?
হতেও পারে। কিন্তু ‘ইলহা দা কিমাদা গ্রান্দে’ (Ilha da Queimada Grande) দ্বীপটিকে নিয়ে এরকমই এক লোককথা আছে। দ্বীপটিকে বলা যায় সর্পদ্বীপ। এটি যে এক অতি বিষধর সাপের অবাধ চারণভূমি, তা নিয়ে দ্বিমত নেই। বলা হয়, দ্বীপের প্রতি মিটার বর্গক্ষেত্রে একটি করে সাপ বর্তমান। সাপটির নাম ‘গোল্ডেন ল্যান্সহেড পিট ভাইপার’ (Golden Lancehead Pit Viper)। যেভাবে গা-ঢাকা দিয়ে থাকে, মনে হবে বুঝি শুকনো পাতা পড়ে আছে। কিন্তু সেটাই ছলনার ছন্দ।
ব্রেজিলের মূল ভূখণ্ডে যে ‘ল্যান্সহেড’ সাপ পাওয়া যায়, তার জন্যই সে দেশের অধিকাংশ সর্পাঘাতজনিত মৃত্যু ঘটে। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, ‘গোল্ডেন ল্যান্সহেড’-এর বিষের তীব্রতা ‘ল্যান্সহেড’-এর পাঁচগুণ। কিডনি ও পেশীকে অচল করে আহত ব্যক্তিকে খুব দ্রুতগতিতে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, ক্ষতস্থানের সংলগ্ন মাংস গলিয়ে দেওয়ারও ক্ষমতা ধরে এই বিষ।
এত তীব্র?
এই সাপের বিবর্তনের ইতিহাসটা বললে হয়ত তীব্রতার কারণটা বোঝাতে পারব। প্রায় ১১,০০০ বছর আগে গত তুষার যুগের (Ice age) শেষে, বরফ গলার ফলে সমুদ্রের জল বেড়ে যায়। এর ফলে ব্রেজিলের কিছু অংশ জলমগ্ন হয়। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘কিমাদা গ্রান্দে’ দ্বীপটি তৈরি হয়। ধীরে ধীরে সেখানে স্থলচর প্রাণী বিরল হয়ে পড়ে। এর ফলে, সেখানকার সাধারণ ‘ল্যান্সহেড’ সাপগুলি খাদ্যাভাবে বিপর্যস্ত হয়। কিন্তু খেতে তো হবে। সাপগুলি মাটি ছেড়ে গাছে উঠে শিকার করা শুরু করে। পরিযায়ী পাখিরা ক্লান্ত হয়ে দ্বীপে বিশ্রাম নিতে আসে। তাদেরই শিকার করতে হবে। অথচ তাতেও একটা অসুবিধা আছে। সাপের কামড় খেয়ে পাখিগুলো উড়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। এতে পাখি মারা পড়ে ঠিকই, কিন্তু সাপটি তাকে খেতে পারে না।
এর একমাত্র সমাধান বিবর্তন। প্রকৃতি ‘ল্যান্সহেড’-এর বিষের তীব্রতা এতটাই বাড়িয়ে দিল, যে পাখিগুলো কামড় খেয়ে সেখানেই পড়ে যায় এবং সাপটিও সহজে শিকার করে জীবনধারণে সক্ষম হয়। শিকারীর অভাব কিন্তু শিকারের প্রাচুর্য – এর সৌজন্যে দ্বীপটি সর্পরাজ্য হয়ে ওঠে।
জলদস্যুর গুপ্তধন পেলে জীবনটাই হয়ত অন্যরকম হয়ে যেত। কিন্তু যে ‘যখ ‘ তা পাহারা দিচ্ছে, তার কথা ভাবলে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্করও হয়ত অভিযান মুলতুবি রাখত।