মগজধোলাই ২.০

মগজধোলাই ২.০

সুপ্রতিম চৌধুরী
Posted on ২১ নভেম্বর, ২০২১

বিড়াল আর ইঁদুরের বৈরিতা নিয়ে কি নতুন করে কিছু বলার আছে? ইঁদুর দেখলে বিড়াল যে লালায়িত হয়, সে তো ‘টম’ আর ‘জেরি’-র সুবাদে ছোট থেকেই জানা। মানছি, ইউটিউবে অল্প কিছু ব্যতিক্রমী ভিডিওতে হয়ত উলট-পুরাণ দেখা গেলেও যেতে পারে। তা সত্ত্বেও, বিড়ালের স্বভাবজাত প্রবণতাটাকে তো উপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু যদি কখনো দেখেন আপনার ঘরের কোণের গর্ত থেকে একটা ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়ে আপনার পোষা বিড়ালটার কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়াল? চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাবে তো? ম্যাজিক ভাববেন, তাই না?

বিজ্ঞানভাষের ‘মগজধোলাই’ কিস্তিটা যদি পড়ে থাকেন, তাহলে পরজীবি ছত্রাক সম্বন্ধে ধারণা নিশ্চয়ই তৈরী হয়েছিল। কেমন ভাবে তা নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে নিরীহ পিঁপড়ের মস্তিষ্ককে দখল করে ধীরে ধীরে তার সমগ্র উপনিবেশকে কব্জা করে ফেলে। কিন্তু সেটা পড়ে যদি তাজ্জব হয়ে থাকেন তাহলে আজকের লেখা পড়লে হতবাক হয়ে ভাববেন, একটি অতি নগণ্য এককোষী জীব কীভাবে বিবর্তনের সারণীতে তার চেয়ে অনেকগুণে উন্নত প্রাণীর মস্তিষ্ককে নিজের চাহিদায় ইচ্ছেমত ‘wiring’ করে নেয়।

ভাল নাম টক্সোপ্লাস্মা গণ্ডিয়াই (Toxoplasma gondii)। এই পরজীবির জীবনচক্র সম্পূর্ণ হয় একাধিক প্রাণীর সাহায্যে। সে তো ম্যালেরিয়ার ‘প্যারাসাইট’- এর ক্ষেত্রেও হয়! তা হয় ঠিকই। কিন্তু টক্সোপ্লাস্মার ‘modus operandi’-ই আলাদা। এই পরজীবির জন্মের শুরু বিড়ালাদি প্রাণীতে (Felids)। বিড়ালাদি বলতে বিড়াল, চিতা, বাঘ, সিংহ – এইসব। এদের পৌষ্টিকতন্ত্রে টক্সোপ্লাস্মা বংশবিস্তার করে এবং তার ফলে উৎপন্ন ‘ঊসিস্ট’-গুলি (oocyst) প্রাণীর বর্জ্যপদার্থের সাথে বেরিয়ে আসে। এটাই টোপ।

এবার সেকণ্ড ইনিংস। পরজীবির জীবনের দ্বিতীয় ধাপে সে অন্যান্য উষ্ণ-রক্তবিশিষ্ট প্রাণী (Warm-blooded animal) খোঁজে যার দেহের মধ্যে সে বড় হয়ে উঠবে। বড় তো হল, কিন্তু পুনরায় বিড়ালের মধ্যে ঢুকবে কী করে? এইখানেই সেই মগজধোলাইয়ের গল্প। ইঁদুর যে বিড়ালকে এড়িয়ে চলে তার কারণ হল বিড়ালের মূত্র থেকে ইঁদুর টের পায়, ‘আচ্ছা, এই অঞ্চলে শিকারী ওঁত পেতে রয়েছে।’ টক্সোপ্লাস্মা এই মনস্তত্ত্বকেই কাজে লাগায়। ইঁদুরের মস্তিষ্কের ‘অ্যামিগডালা’ (Amygdala) অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে পরজীবি। ভয়, রাগ – এই জাতীয় আবেগ সৃষ্ট হয় এখানে। আক্রান্ত ইঁদুর টক্সোপ্লাস্মার আনুগত্যে বিড়ালের মূত্র টের তো পায়, কিন্তু ভয়ে সরে পড়ার বদলে আকৃষ্ট হয়ে তার কাছেই আরো এগিয়ে যায়।

ফলে যা হওয়ার তাই হয়। ইঁদুরের মধ্য দিয়ে টক্সোপ্লাস্মা আবার ‘বাপের বাড়ি’ ফিরে আসে। তারপর আবার সেই বংশবিস্তার, নতুন প্রজন্মকে নতুন শিকারের খোঁজে যত্রতত্র ছড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি।

খুব আশ্চর্যজনক, না? এবার যদি বলি, শুধু ইঁদুরেই না, ট্যাক্সোপ্লাস্মোসিস (Toxoplasmosis) বা উক্ত পরজীবির আক্রমণ ছড়ায় মানুষেও? ভয় পাবেন?

না, ভয়ের কারণ ততটা নেই। মানুষের মধ্যে ছড়ালেও তা খুব একটা গুরুতর নয়। মূলতঃ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও আধসেদ্ধ মাংস থেকে এই রোগ ছড়ায়। বিশেষ করে বাড়ির পোষা বিড়ালের বর্জ্য (Cat litter) পরিষ্কার করা থেকেও রোগ হতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের এই কারণে খুব সাবধান থাকা উচিত। এতেই শেষ নয়। মনে করা হয়, এর কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে স্কিৎজোফ্রেনিয়া জাতীয় মানসিক রোগ হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। এমনকি অনেক পথ-দুর্ঘটনার কারণও টক্সোপ্লাস্মার প্রভাবে হয়ে থাকে বলে ধরা হয়। তবে এর সত্যাসত্য বিচার গবেষণাধীন। হলফ করে বলা যায় না।

কিন্তু এটা তো বুঝলেন যাদের চোখে দেখা যায় না, রমরমা তাদেরই। তার নাম করোনা হোক বা টক্সোপ্লাস্মা।

ছবি সৌজন্যঃ এবিসি নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

7 + nineteen =