ময়ূরাক্ষী অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের স্থানিক ও কালিক বৈশিষ্ট্য

ময়ূরাক্ষী অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের স্থানিক ও কালিক বৈশিষ্ট্য

অঙ্কিতা গাঙ্গুলী
বিজ্ঞানভাষ সম্পাদকীয় বিভাগ
Posted on ৫ জুলাই, ২০২৫

বৃষ্টি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান যা সরাসরি জলসম্পদ এবং কৃষিকে প্রভাবিত করে। জলসম্পদের কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের নির্ভুল পরিমাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় উপমহাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বৃষ্টি জল সরবরাহের প্রধান উৎস হলেও সাম্প্রতিক দশকে বৃষ্টিপাতের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বেড়েছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন পশ্চিম ভারতের রাজস্থানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত মাত্র ১০০ মিমি, আবার উত্তর-পূর্ব ভারতে এটি অনেক বেশি।
জলপ্রবাহের ধরণ, মৃত্তিকার আর্দ্রতা ও ভূগর্ভস্থ জলের পুনরাগমন —সবকিছুই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রভাবিত হচ্ছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত দীর্ঘকালীন খরা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণ হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট এই ধরনের পরিবর্তন কৃষিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে।
এই পরিবর্তনগুলি বিশ্লেষণ করার জন্য মান-কেন্ডাল (Mann-Kendall) পরীক্ষা, Sen’s Slope এবং পেটিটের পরীক্ষা (Pettitt Test) ইত্যাদি পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও, দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টিপাতের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণে স্ট্যান্ডার্ড নর্মাল হোমোজিনিটি টেস্টসহ বিভিন্ন সূচক যেমন- PCI, RSI ও RAI ব্যবহৃত হয়। এগুলি খরা ও ঋতুভিত্তিক বৈচিত্র্য বুঝতে সহায়তা করে।
এই গবেষণায় পূর্ব ভারতের ময়ূরাক্ষী অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন, প্রবণতা ও ঋতুভিত্তিক বৈচিত্র্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই অববাহিকা কৃষি, সেচ, পানীয় জলের যোগান এবং মৎস্যচাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদী ও তার উপনদীগুলিতে একাধিক বাঁধ ও বহুমুখী প্রকল্প রয়েছে।
গবেষণার উদ্দেশ্য হলো বৃষ্টিপাতের প্রবণতা ও স্থানিক-কালিক বৈচিত্র্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য কার্যকর কৃষি ও জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার কৌশল নির্ধারণ করা।

ময়ূরাক্ষী নদী পূর্ব ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী ব্যবস্থাগুলোর একটি। এর উৎস ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ছোটনাগপুর মালভূমির ত্রিকুট পাহাড় থেকে। ময়ূরাক্ষী অববাহিকা ২৩°৬৩′ ১২′′ থেকে ২৪° ৫১′ ৩′′ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৬° ৮৪′ ৩৮′′ থেকে ৮৮° ১৬′ ১২′′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত, যা ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত। এর মোট আয়তন ৮৮০৫.০৬ বর্গ কিমি। ভূতাত্ত্বিকভাবে অববাহিকার উপরের অংশ প্রধানত প্রোটেরোজোইক এবং ফ্যানেরোজোইক অধিযুগের অখণ্ড প্রিক্যাম্ব্রিয়ান শিলার গঠনে গঠিত। অববাহিকার মধ্যবর্তী অংশ প্রধানত ল্যাটারাইট মাটি এবং নিম্ন অংশ নবীন ও প্রাচীন পলিমাটিতে আবৃত।

ময়ূরাক্ষী অববাহিকার উপরের অংশে ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত অসমতল, যেখানে অনেক বিচ্ছিন্ন সমতল শীর্ষযুক্ত পাহাড় রয়েছে, যেগুলির উচ্চতা ৩০০ মিটারের বেশি। অববাহিকার মধ্যবর্তী অংশ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অন্তর্গত, যা ‘রাঢ় অঞ্চল’ নামে পরিচিত। এটি ছোটনাগপুর মালভূমির পূর্ব দিকে বিস্তৃত ঢেউখেলানো অংশের অন্তর্ভুক্ত, যার উচ্চতা ৭১ থেকে ১২০ মিটার পর্যন্ত।অববাহিকার নিম্নভাগ প্রধানত নিম্নভূমি ,বন্যাপ্রবণ।

1991 থেকে 2020 সাল পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের তথ্য ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (IMD), পুনে থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাপ্ত দৈনিক গ্রিডযুক্ত বৃষ্টিপাতের তথ্য (মিলিমিটারে) উচ্চ স্থানিক রেজোলিউশন সম্পন্ন, যার মাত্রা 0.25 × 0.25 ডিগ্রি। বৃষ্টিপাতের তথ্য সংগ্রহ করার পর, তথ্যে অনুপস্থিত মান সংশোধন করা হয় এবং অধ্যয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলগুলিকে নির্বাচন করা হয়। মোট ২৩টি অঞ্চল মারফত সমগ্র অধ্যয়ন এলাকাকে দেখানো হয়েছে। অঞ্চলগুলোতে বৃষ্টিপাতের তথ্য দৈনিক, মাসিক এবং বাৎসরিক ভিত্তিতে বিন্যস্ত করা হয়েছে।
ম্যান-কেন্ডাল (এম কে) একটি নন-প্যারামেট্রিক পরীক্ষা, যা সময়কাল ভিত্তিক তথ্যের প্রবণতা বিশ্লেষণের জন্য উপযুক্ত, দীর্ঘমেয়াদী এবং স্বল্পমেয়াদী উভয় ক্ষেত্রেই। এটি ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বা হ্রাসপ্রাপ্ত প্রবণতার কার্যকর মূল্যায়নে সহায়ক। নন-প্যারামেট্রিক প্রকৃতির কারণে, এম কে পরীক্ষাকে বিভিন্ন ধরণের তথ্য বিশ্লেষণে প্রয়োগ করা যায়। ফলে এটি সময়কাল ভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণের জন্য অন্যান্য পরিসংখ্যানগত পদ্ধতির তুলনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি হয়ে উঠেছে।

ময়ূরাক্ষী অববাহিকার ১৯৯১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কালের বৃষ্টিপাতের স্থানিক ও কালিক পরিবর্তন বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মোট ২৩টি বৃষ্টিপাত স্টেশনের তথ্য ব্যবহার করে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।
প্রথম দশকে (1991–2000)
বৃষ্টিপাতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যায়। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত ছিল যথাক্রমে 1964.86 মিমি এবং 1288.99 মিমি; গড় ছিল 1557.10 ± 174.44 মিমি। অববাহিকার উপরের অংশে বৃষ্টিপাতের ঘনত্ব বেশি ছিল।
দ্বিতীয় দশকে (2001–2010)
গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ছিল 1430.30 ± 155.26 মিমি এবং পরিবর্তনশীলতা তুলনামূলকভাবে কম ছিল (CVR 10.85)। উপরের ও মাঝারি অংশের উত্তর-পূর্ব এলাকায় বৃষ্টিপাতের ঘনত্ব বেশি ছিল।
তৃতীয় দশকে (2011–2020)
বৃষ্টিপাত হ্রাস পেয়েছে, গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ছিল 1207.24 ± 138.41 মিমি। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত ছিল যথাক্রমে 1438.68 মিমি ও 989.27 মিমি। উপরের অঞ্চল থেকে নিচের দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে দেখা গেছে।
সম্পূর্ণ ৩০ বছরের গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ছিল 1398.21 ± 139.95 মিমি। উপরের ও মাঝারি অংশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলগুলিতে বৃষ্টিপাতের ঘনত্ব সর্বদা বেশি ছিল, যখন নিচের অংশে তুলনামূলকভাবে কম বৃষ্টিপাতের পরিমাণ রেকর্ড করা হয়েছে।
ভৌগোলিক দিক থেকে অববাহিকার উপরের অংশটি মালভূমি অঞ্চলে অবস্থিত, যা বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাতের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। ফলে এই অঞ্চলে নিচের অংশের তুলনায় বৃষ্টিপাত বেশি হয়েছে।

ময়ূরাক্ষী অববাহিকায় গত ৩০ বছরে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বিশ্লেষণে পরিমার্জিত “এম কে” পরিসংখ্যান পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে Kendall’s Z মান -1.67 এবং Sen’s slope -10.40, যা বৃষ্টিপাতে হ্রাসমান প্রবণতা নির্দেশ করে। ২৩টি স্টেশনের মধ্যে একটি ব্যতীত সব স্টেশনে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে।
বিশেষ করে ৫টি স্টেশনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হ্রাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেখানে Sen’s slope -25.77 থেকে -17.20 এবং Z মান -5.00 থেকে -2.00 এর মধ্যে ছিল।
এই ফলাফলগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং অববাহিকায় ক্রমাগত বৃষ্টিপাত হ্রাসের দিক নির্দেশ করে।

বৃষ্টিপাতের ঋতুভিত্তিক চরিত্র- গবেষণায় অববাহিকায় দীর্ঘমেয়াদী বৃষ্টিপাতের ধরন বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিটি স্টেশনের ৩০ বছরের তথ্য বিবেচনা করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ঋতুভিত্তিক বৈচিত্র বোঝা।

ফলাফল অনুযায়ী, অববাহিকায় বৃষ্টি পাতের দুটি প্রধান শ্রেণির ঋতুভিত্তিক বৈচিত্র সূচক (RSI) সনাক্ত করা হয়েছে:
১. খুবই সাম্যাবস্থাপূর্ণ RSI < 0.19
2. সাম্যাবস্থাপূর্ণ কিন্তু অনির্দিষ্ট আবহাওয়া RSI 0.20 থেকে 0.39 এর মধ্যে। ৩০ বছরের পুরো সময়কাল বিবেচনা করে দেখা যায়, ৬০% বছরে বৃষ্টিপাত খুবই সাম্যাবস্থাপূর্ণ ছিল, এবং বাকি ৪০% বছরে সাম্যাবস্থাপূর্ণ কিন্তু অনির্দিষ্ট আবহাওয়া লক্ষ্য করা গেছে, যা বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত।
দশকভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, উপরের ও মাঝারি অববাহিকায় (মালভূমি) প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে RSI মান ছিল 0.20–0.39, যা স্থিতিশীল বৃষ্টিপাত নির্দেশ করে। তৃতীয় দশকে, নিম্ন অববাহিকার দক্ষিণ অংশে RSI মান 0.20-এর ওপরে ছিল।
গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে ৫৬.৬৭% বছরে খুবই সাম্যাবস্থাপূর্ণ এবং ৪৩.৩৩% বছরে সাম্যাবস্থাপূর্ণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। নিম্ন অববাহিকায় ভূ-প্রকৃতিগত বাধা না থাকায় বৃষ্টিপাতে অনিশ্চয়তা বেশি। এই অঞ্চল প্রধানত ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের অংশ, যেখানে কৃষি প্রধানত বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল এবং একফসলী।
RSI বিশ্লেষণ কৃষি পরিকল্পনা ও অঞ্চলভিত্তিক ফসল নির্বাচন এবং কৃষি বৈষম্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

উপসংহার

এই গবেষণায় ময়ূরাক্ষী অববাহিকার ৩০ বছরের বৃষ্টিপাতের স্থানিক ও কালিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ফলাফলে দেখা গেছে, উপরের ও মাঝারি অংশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে (১৫০০-১৭০০মিমি), যেখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ছিল ১৩৯৮.২১ ± ১৩৯.৯৫ মিমি। নিম্ন অববাহিকায় বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে (Kendall’s Z ও Sen’s slope) বৃষ্টিপাতের হ্রাসমান প্রবণতা পাওয়া গেছে এবং ২০০৮ সাল-কে বৃষ্টিপাত পরিবর্তনের প্রধান বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
Rainfall Anomaly Index (RAI) অনুযায়ী অঞ্চলটিতে কিছু বছর ছিল অতিসিক্ত, আবার কিছু বছর ছিল অতিশুষ্ক, যা বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দেয়।
আগের গবেষণাগুলোর মতোই এই গবেষণায়ও উল্লেখ করা হয়েছে যে, অঞ্চলটি কৃষিক্ষেত্রে আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্যের মুখোমুখি এবং অঞ্চলটি একফসলি কৃষি প্রধান।
এই গবেষণায় প্রাপ্ত RSI, RAI এবং ক্ষুদ্রমাত্রিক ফসলের তথ্য নির্বাচন ও জলসম্পদ পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ফলাফলগুলো পরিকল্পনাকারী ও গবেষকদের জন্য সহায়ক হবে ফসল ঘনত্ব উন্নয়ন, কৃষি সূচক নিরূপণ এবং আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণে। যাতে অববাহিকায় জলসম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five − one =