মস্তিষ্কের বার্ধক্যরোধে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যায়াম

মস্তিষ্কের বার্ধক্যরোধে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যায়াম

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৯ নভেম্বর, ২০২৫

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে,বিশেষত মনোযোগ, স্মৃতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। কিন্তু কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এমন এক চমকপ্রদ উপায় আবিষ্কার করেছেন, যা মস্তিষ্কের এই প্রাকৃতিক অবক্ষয়কে রোধ করতে পারে। তাঁদের সাম্প্রতিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, মাত্র ১০ সপ্তাহের প্রযুক্তি নির্ভর মস্তিষ্কের ব্যায়াম (কোনো একটি নির্দিষ্ট মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে দেখানো হয়) একজন বৃদ্ধ মানুষের মস্তিষ্ককে তার থেকে অন্তত ১০ বছর কম বয়সী মানুষের মতো সক্রিয় ও তীক্ষ্ণ করে তুলতে পারে।

এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি ও নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং দ্য নিউরো (মন্ট্রিয়াল নিউরোলজিক্যাল ইন্সটিটিউট হসপিটাল )-এর স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ড. এতিয়েন দে ভিলার্স-সিদানি। তিনি জানিয়েছেন মাত্র দশ সপ্তাহের অনুশীলনে অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কের কোলিনার্জিক কার্যক্ষমতা এমন স্তরে পৌঁছেছে, যা সাধারণত ১০ বছর কম বয়সীদের মধ্যে দেখা যায়।

এই প্রথমবার কোনো ওষুধবিহীন হস্তক্ষেপে মানব মস্তিষ্কের রাসায়নিক গঠন এভাবে পুনরুদ্ধার হতে দেখা গেল।

মস্তিষ্কের কোলিনার্জিক ফাংশান হল শরীর ও মস্তিষ্কের সেইসব কাজ, যেগুলো অ্যাসিটাইল কোলিন নামক রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এগুলি মনোযোগ, স্মৃতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পেশি সঙ্কোচন, হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ, পরিপাক প্রক্রিয়া, এমনকি ঘাম ও লালা নিঃসরণের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বয়স বাড়লে এই সিস্টেম দুর্বল হয়ে যায় এবং অ্যালঝেইমার্স রোগের মূল সূচকগুলোর একটি হয়ে ওঠে। তাই এই আবিষ্কারটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি প্রমাণ করে যে, নির্দিষ্ট মস্তিষ্কের অনুশীলন ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে ও স্মৃতিশক্তি রক্ষা করতে সক্ষম হতে পারে , সম্পূর্ণভাবে ওষুধ ছাড়াই।

গবেষণায় ব্যবহৃত অ্যাপটির নাম ব্রেইন এইচ কিউ। এটি একটি গেম-ভিত্তিক অনলাইন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম, যা ব্যবহারকারীর শেখার গতি ও মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য তৈরি। প্রতিটি অনুশীলনের স্তর ক্রমে কঠিন হয়, ফলে মস্তিষ্ককে নতুন তথ্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য করে এবং নিউরোপ্লাস্টিসিটি (মস্তিষ্কের অভিযোজন ক্ষমতা) বাড়ায়।

ড. সিদানি বলেছেন , এখনো অনেকেরই ধারণা ক্রসওয়ার্ড বা পড়াশোনাই মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে, কিন্তু এগুলো প্রকৃতপক্ষে মস্তিষ্কের গঠনগত পরিবর্তন ঘটায় না। কিন্তু এই অ্যাপের অনুশীলনীগুলো সেই পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

এই গবেষণায় অংশ নেন ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ৯২ জন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক। তাঁদের দুই দলে ভাগ করা হয়। এক দল প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে ব্রেইন এইচ কিউ ব্যবহার করে, অন্য দল খেলেছে সাধারণ কম্পিউটার গেম। ১০ সপ্তাহ পর দেখা যায়, কেবলমাত্র ব্রেইন এইচ কিউ ব্যবহারকারীদের মস্তিষ্কে কোলিনার্জিক কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এর ফলাফল যাচাই করতে গবেষকরা ব্যবহার করেন পি ই টি স্ক্যান এবং একটি বিশেষ অনুসন্ধানকারী প্রযুক্তি, যা মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তন অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম। এই প্রযুক্তি বিশ্বের খুব অল্প কয়েকটি কেন্দ্রে পাওয়া যায়।

এখন বিজ্ঞানীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে পরীক্ষা করতে চান এই প্রশিক্ষণ ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ের রোগীদের জন্যও কার্যকর হয় কি না।

এই আবিষ্কার প্রমাণ করছে, মস্তিষ্কের এই প্রযুক্তিনির্ভর ব্যায়াম কেবল মস্তিষ্ককে সচলই রাখে না, বরং এটি হতে পারে বার্ধক্য রোধের এক নিরাপদ ও বৈজ্ঞানিক বিকল্প – যা ওষুধের প্রয়োজন ছাড়াই স্মৃতি, মনোযোগ ও বুদ্ধিবৃত্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম।

 

সূত্র : “Effects of Computerized Cognitive Training on Vesicular Acetylcholine Transporter Levels using Fluoroethoxybenzovesamicol Positron Emission Tomography in Healthy Older Adults: Results from the INHANCE Randomized Clinical Trial” by Mouna Attarha, Ana de Figueiredo Pelegrino,13th October 2025, JMIR Serious Games.

DOI: 10.2196/75161

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven − 1 =