আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকে বলা যায় মহাকাশে মানুষের পান্থনিবাস। রাশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপীয় সঙ্ঘ, জাপান ও কানাডার যৌথ উদ্যোগে এটি স্থাপন করার জন্য বহু বছরের আন্তর্জাতিক প্রয়াস ও প্রস্তুতি পূর্ণতা অর্জনের পথে এগোয় ১৯৯৮ সালের ২০ নভেম্বর। ওইদিন রাশিয়ার জারিয়া নামক মডিউল উৎক্ষেপণ করা হয়। দু সপ্তাহ পরে আমেরিকার ইউনিটি মডিউল গিয়ে তার সঙ্গে যোগ দেয়। অতঃপর ২০০০ সালের জুলাইতে রাশিয়া তার জ্ভেজ্দা মডিউলটি উৎক্ষেপণ করল। সেই থেকে ওই পান্থনিবাস হয়ে উঠল মানুষের বাসের উপযোগী। সন্দেহ নেই, মহাবিশ্বে মানুষের এ এক বিরাট অভিযান।
কিন্তু আজ প্রায় ২৫ বছর পেরিয়ে মহাকাশে মানুষের এই পান্থনিবাসের অবস্থা বেশ সঙ্গীন। ফাটল ধরেছে দেওয়ালে, জল পড়ছে, এমনকী দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। মহাকাশে মানুষের ফেলে আসা আবর্জনা মাঝে মাঝে দুমদাম ধাক্কা মারছে। অতএব এবার তাকে বিদায় দিতে হবে। ঠিক হয়েছে ২০৩১ সালে তাকে “নিরাপদে” নামিয়ে আনা হবে। তিনটে মূল ধাপে এ কাজ সমাধা হবে। বারো থেকে আঠেরো মাস সময় দেওয়া হবে ওর স্বাভাবিক অবক্ষয়ের জন্য। তারপর ইচ্ছে করে ওটাকে একটু নামিয়ে আনা হবে । সবেশেষে তাকে নিরাপদে পৃথিবীর আবহমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশ করানো হবে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, কতদূর নিরাপদ হবে এ প্রক্রিয়া? পৃথিবীতে নামিয়ে এনে কোথায় ফেলা হবে তাকে? পৃথিবীর জল আর বায়ু কীভাবে দূষিত হবে তার দ্বারা? শোনা যাচ্ছে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে ওই মহাকাশ-নিবাসটিকে নামিয়ে এনে ফেলা হবে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের “পয়েন্ট নিমো” নামে একটা জায়গায়। সে জায়গাটা পৃথিবীর যেকোনো জনবসতি থেকে বহু দূরে। তাকে বলা হয় “মহাকাশযানের কবরখানা”। স্বভাবতই এর ভালো-মন্দ নিয়ে বেধেছে বিতর্ক।
এরই মধ্যে নাসা থেকে স্পেস-এক্স নামে এক সংস্থাকে এর জন্য প্রয়োজনীয় নকশা বানাবার ভার দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তার মানে, পুরো পান্থনিবাসটাকে একচোটে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এর ওজন কিন্তু বিপুল – ৪৫০ টন। এই পরিমাণ বস্তু যদি একসঙ্গে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তাহলে মহা সমস্যা তৈরি হবে। এই পরিমাণ বস্তু মহাসাগরে গাদিয়ে দিলে তারও খারাপ প্রতিক্রিয়া হবে। তবে কোনো কোনো বিজ্ঞানী আবার হিসেব করে দেখাচ্ছেন, মহাসাগর দূষণে মহাকাশ থেকে নামিয়ে নিয়ে আসা এইসব বস্তুর অবদানের মাত্রা অতি নগণ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একটা মাত্র যুদ্ধজাহাজ ডুবে গেলে তার যা ওজন তার কাছে এ তো কিছুই না। শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেন, প্রতি বছর এমনিতেই যত জাহাজ আর মালপত্র সমুদ্রে ডুবে যায়, কিংবা যে-পরিমাণ সামুদ্রিক আবর্জনা তৈরি হয়, তার কাছেও এই ৪৫০ টন কিছু না। সুতরাং একদল বিজ্ঞানীর মতে মহাকাশের পান্থনিবাসকে সমুদ্রে এনে ফেললে তা থেকে যে-দূষণ হবে তা মানুষের অন্যান্য কর্মকাণ্ড কিংবা প্রাকৃতিক ঘটনা জনিত দূষণের তুলনায় উল্লেখযোগ্য নয়। বরং আসল সমস্যাটা হবে উচ্চতর আবহমণ্ডলে। পৃথিবী থেকে মহাকাশযান উৎক্ষেপণ আর মহাকাশ থেকে আবহমণ্ডলে তার পুনঃপ্রবেশ এরই মধ্যে গুরুতর সমস্যা তৈরি করেছে। সমস্যার মাত্রা কতটা তা এখনো আমরা ভালো করে জানি না।
অন্য একদল বিজ্ঞানী আবার বলছেন, সমুদ্রের দূষণ নিয়ে যাঁরা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন যে এর বিকল্পটা কত মারাত্মক। সে-বিকল্পটা হল কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ভাঙা পান্থনিবাসটাকে আছড়ে পড়তে দেওয়া। কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছেন, একচোটে অতবড়ো জিনিসটাকে নামিয়ে না-এনে টুকরো টুকরো করে নামিয়ে আনা হোক। কিংবা পুরো নিবাসটাকে প্যাক করে মহাকাশে উচ্চতর কোনো কক্ষপথে স্থাপন করা হোক অথবা আমাদের গ্রহের বিপরীত মুখে কোনো পথে দূরে চালান করে দেওয়া হোক। কিন্তু এসবের খরচ অত্যধিক।
আরও একটা দুশ্চিন্তা হল পৃথিবীর আবহমণ্ডলে নতুন করে ঢোকবার সময় যে-পরিমাণ পদার্থ বাষ্পীভূত হয়ে যাবে তা নিয়ে।
সব মিলিয়ে ব্যাপারটা খুবই দুশ্চিন্তাজনক। কোন পথে এর সমাধান? যে-পথের কথাই ভাবা হোক, কেউ না কেঊ তাতে অখুশি হবেই। অথচ সমস্যাটা কিন্তু দিনকে দিন ঘোরালো হয়ে উঠছে।