মহাকাশে মানুষের স্বাস্থ্য-পরীক্ষা

মহাকাশে মানুষের স্বাস্থ্য-পরীক্ষা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১০ অক্টোবর, ২০২৫

চাঁদে এবং পরবর্তীতে মঙ্গলে, মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে নাসা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দীর্ঘ সময় গভীর মহাকাশে থাকলে মানুষের শরীরে কী ঘটবে? এই রহস্য উন্মোচনেই নাসা শুরু করতে যাচ্ছে এক অভিনব পরীক্ষা, যেখানে জীবন্ত মানবকোষ বহনকারী ক্ষুদ্র ল্যাব যন্ত্রকৌশল পাঠানো হবে মহাকাশে। এই উদ্যোগের নাম ‘অবতার’। গবেষণার কেন্দ্রে রয়েছে ‘অর্গান-অন-এ-চিপ’ প্রযুক্তি। এটি আকারে প্রায় একটি থাম ড্রাইভের মতো, কিন্তু এর ভেতরে সাজানো থাকে মানব কোষ, যেগুলো নির্দিষ্ট অঙ্গের মতো কাজ করে। যেমন ফুসফুস, লিভার, হৃৎপিণ্ড বা মস্তিষ্ক। ওষুধ বা বিকিরণের প্রতিক্রিয়ার পূর্বাভাস দিতে, পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই এই ধরনের চিপ ব্যবহার হয়। ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিকল্পনা গড়ে তুলতে, নাসা এখন এই প্রযুক্তিই কাজে লাগাবে মহাকাশ অভিযাত্রীদের জন্য । চিপগুলিকে একত্রিত করলে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অঙ্গের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারেন, যা অনেক সময় একক কোষকলা পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে না। এই মিশনের প্রথম ধাপ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে অস্থিমজ্জা। এটি আমাদের শরীরে লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা এবং প্লেটলেট তৈরির কারখানা। একই সঙ্গে, এটি বিকিরণের প্রতি সবচেয়ে সংবেদনশীল কোষকলাগুলোর একটি। মহাকাশযাত্রার সময় মহাজাগতিক রশ্মি ও সৌরকণার প্রভাবে অস্থিমজ্জায় পরিবর্তন হলে তা রক্ত তৈরির প্রক্রিয়া, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এবং অক্সিজেন পরিবহণকে সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে। পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোগ্রাভিটি বা ক্ষুদ্র অভিকর্ষ হাড়ের গঠন ও অস্থিমজ্জার পরিবেশ বদলে দেয় । এসব পরিবর্তনের ঢেউ গিয়ে লাগে পুরো রোগপ্রতিরোধী ব্যবস্থায়, যা কোনো দীর্ঘমেয়াদি মহাকাশচারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আসন্ন আর্টেমিস-II মিশনে ব্যবহার হবে রক্ত তৈরির স্টেম সেল থেকে গড়ে তোলা অস্থিমজ্জা চিপ। এগুলো সংগ্রহ করা হবে সেই একই মহাকাশচারীদের রক্ত থেকে, যারা মিশনে যাচ্ছেন। ফলে তুলনা করা যাবে—একই ব্যক্তির কোষ পৃথিবীতে ও মহাকাশে কেমন আচরণ করছে। এতে অনুমান বা পরোক্ষ ধারণার কোনো জায়গা নেই। চিপগুলো রাখা হবে একটি স্বয়ংক্রিয় বাক্সে, যা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অবধি কোষকে পুষ্টি দেবে। এই ব্যবস্থা তৈরি করেছে ‘স্পেস ট্যাংগো’ যাতে মহাকাশচারীদের সময় বাঁচে এবং তারা কেবল নিরাপদে উড়ান পরিচালনায় মনোযোগ দিতে পারে। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র আমাদের অনেক মহাজাগতিক কণিকা থেকে রক্ষা করে। কিন্তু একবার মহাকাশযান যখন চাঁদের দূরত্বে পৌঁছায়, তখনই বাড়ে বিকিরণের ঝুঁকি। আর্টেমিস-I মিশন ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে, মহাকাশযানের অভ্যন্তরে বিকিরণ মাত্রা ঢাল এবং অবস্থান অনুযায়ী ভিন্ন হয়। অবতারের চিপ এবার দেখাতে পারে, এই বিকিরণ মানবকোষে ঠিক কী প্রভাব ফেলছে। ফেরার পর বিজ্ঞানীরা, চিপগুলির কোষে একক কোষের আর এন এ সিকোয়েন্সিং চালাবেন। এতে হাজারো জিনের কার্যকলাপ এক এক করে বোঝা যাবে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, মহাকাশে থাকা রক্ত গঠনকারী কোষগুলোতে ত্বরান্বিত বার্ধক্যের চিহ্ন ফুটে ওঠে। ফলে এই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাসার জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক লিসা কারনেল বলেন, “অর্গান চিপ ভবিষ্যতের গভীর মহাকাশ অভিযানে নভোচারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য তথ্য সরবরাহ করবে।” এই প্রযুক্তি শুধু মহাকাশেই নয়, পৃথিবীর চিকিৎসাশাস্ত্রেও প্রভাব ফেলবে। যেমন, এমুলেট কোম্পানির তৈরি অস্থিমজ্জা চিপ ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে, কীভাবে কোষগুলো ওষুধ বা বিকিরণের প্রতিক্রিয়া জানায়। এর ফলে ক্যান্সার চিকিৎসার সঠিক মাত্রা নির্ধারণ বা রোগীর ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে চিকিৎসা দেওয়া সহজতর হবে। আর্টেমিস-II মিশনে, চিপগুলি প্রায় ১০ দিন মহাকাশে থাকবে। এটি একধরনের অভ্যাস গড়ে তুলবে। গভীর মহাকাশে মানব জীববিদ্যা পর্যবেক্ষণ করা যাবে বাস্তব সময়ে। ভবিষ্যতে চিপ প্রযুক্তি আরও উন্নত হলে হৃদ্‌যন্ত্র, মস্তিষ্ক, ফুসফুস বা লিভারের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়াও ধাপে ধাপে বোঝা যাবে। এই তথ্য শুধু ঝুঁকি শনাক্ত করতেই সাহায্য করবে না, প্রতিটি নভোচারীর জন্য ব্যক্তিগত চিকিৎসা কৌশলও নির্ধারণ করবে। দীর্ঘ মিশনের পথে, যেমন মঙ্গলে যাওয়ার সময়, এই জ্ঞান হবে অপরিহার্য।

 

সূত্র : “NASA is sending human cells to the Moon on high-tech microchips that mimic astronaut organs” By Eric Ralls, EarthNews; 26.09.2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three − 2 =