মৌমাছিদের সময়দক্ষতা 

মৌমাছিদের সময়দক্ষতা 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ নভেম্বর, ২০২৫

মৌমাছিদের ক্ষমতা, বিজ্ঞানীদের বরাবরই বিস্মিত করে। রঙ, গন্ধ বা জটিল কোন নকশা শনাক্ত করার দক্ষতা যে তাদের রয়েছে, এ তথ্য পুরোনো। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, ‘বাম্বলবি’ বা ভোমরা-জাতীয় মৌমাছিরা আলোর দীর্ঘ ও স্বল্প ঝলক-কে আলাদা করতে সক্ষম। অর্থাৎ মানুষের তৈরি মর্স কোডের মতো সংকেতের সময়কাল তারা শিখে ফেলতে পারে। এত ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের প্রাণীর ক্ষেত্রে এটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত।

লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যলেক্স ডেভিডসন এবং ড. এলিসাবেত্তা ভার্সাচে পরিচালিত গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল, মানুষের মতোই ‘ডট-ড্যাশ’ ( সময়ের দ্বৈততা- অল্প ও বেশি )। যেমন, মর্স কোডে স্বল্প আলো ‘E’ ও দীর্ঘ আলো ‘T’ নির্দেশ করে। সেই ধাঁচের সংকেত মৌমাছির পক্ষে কোনভাবে বোঝা সম্ভব কি না। পরীক্ষার জন্য তারা একটি ছোট গোলকধাঁধা তৈরি করেন, যেখানে প্রতিটি মোড়ে দুটি বৃত্ত ঝলক দিত। একটি স্বল্প, অন্যটি দীর্ঘ। এর মধ্যে একটি সংকেত মৌমাছিকে নিয়ে যেত চিনির মিষ্টি পুরস্কারের দিকে, আর অন্যটি তিক্ত দ্রবণ দ্বারা নিরুৎসাহিত করত। মৌমাছিরা যেন স্থান দেখে সিদ্ধান্ত না নেয়, তাই প্রতিবারই বৃত্তগুলির অবস্থান বদলে দেওয়া হয়। ফলে বেছে নেওয়ার একমাত্র উপায় ছিল সময়কাল চিনে নেওয়া। কিছুদিনের মধ্যেই মৌমাছিরা সঠিক ঝলক শনাক্ত করতে শিখে যায়। পরে পুরস্কার সরিয়ে দিলেও, তারা আগের মতোই সেই ঝলকের দিকেই উড়ে যায়, যা আগে পুরস্কার দিত। অর্থাৎ, তারা স্পষ্টভাবে সময়ই চিনেছে, অবস্থান নয়। ডেভিডসনের মতে, “প্রাকৃতিক পরিবেশে এই ধরনের আলো ঝলক মৌমাছিরা দেখে না। তবু তারা সময়কাল শিখে ফেলেছে-এটি সত্যিই বিস্ময়কর।“ গবেষকদের ধারণা, চলাচল বা দিকনির্ণয়ে ব্যবহৃত মৌমাছির অন্তর্নিহিত সময়-সংবেদনই এখানে কাজ করেছে। অথবা সময়ের দৈর্ঘ্য বোঝা স্নায়ুতন্ত্রের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য, যা তাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কেও বর্তমান।

সময় প্রক্রিয়াকরণের দক্ষতা সাধারণত বড় মস্তিষ্কের প্রাণীদের আচরণে দেখা যায়। কিন্তু পতঙ্গের মতো ক্ষুদ্র স্নায়ুতন্ত্রেও এমন জটিল ক্ষমতা আছে, এটি গবেষণাকে নতুন দিক দেখাচ্ছে। ড. ভার্সাচের মতে, বিভিন্ন প্রাণীর সময়বোধ বোঝা ‘বিবর্তন গবেষণা’য় গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া ক্ষুদ্র স্নায়ুতন্ত্র কীভাবে এত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে তা জানলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তিগত নকশায় আরও উচ্চমাত্রার দক্ষতা অর্জন সম্ভব। তবে ক্ষুদ্র পতঙ্গদের মধ্যে আরও অনেক অপ্রকাশিত জ্ঞানগত ক্ষমতা থাকতে পারে। সময়-সংকেত শেখার সক্ষমতা দেখায় যে, মৌমাছিরা শুধু পরিশ্রমী সংগ্রাহকই নয়, তাদের রয়েছে অভিযোজনশক্তি ও শেখার উল্লেখযোগ্য দক্ষতা।

 

এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন, আবাসস্থল হারানো, ও কীটনাশকের কারণে মৌমাছি আজ চরম সংকটে। এদের রক্ষা করা মানে শুধু পরিবেশ সংরক্ষণ নয়, প্রকৃতির লুকানো বুদ্ধিমত্তা-কেও বাঁচিয়ে রাখা। মৌমাছির সময়-পরিচালনার ক্ষমতা কোন স্নায়ুবৃত্ত নিয়ন্ত্রণ করে, তা জানা এখনও বাকি। তবে এক বিষয় নিশ্চিত, ক্ষুদ্র প্রাণীর এই সূক্ষ্ম সময়-দক্ষতা আমাদের জীবজগৎ ও প্রযুক্তি উভয় ক্ষেত্রেই নতুন চিন্তার পথ খুলে দিচ্ছে।

 

তথ্যসুত্রঃ Duration discrimination in the bumblebee Bombus terrestris by Alexander Davidson; Biology Letter; 12th November 2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven + nineteen =