অসুখ করলে আমরা ডাক্তার দেখাই। ডাক্তারবাবু অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করে কী অসুখ হয়েছে তা নির্ধারণ ক’রে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসুখ সেরেও যায়। কিন্তু ডাক্তারবাবু কী করে জানলেন কী রোগে কী ওষুধ দিতে হবে? আপাতদৃষ্টিতে উত্তরটা খুবই সোজা। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় উনি ওটা শিখেছেন। প্রশ্নটা কিন্তু গভীরতর। মেডিকেল কলেজের শিক্ষক কোথায় জানলেন তথ্যটা? ওটা তো উনি আবিষ্কার করেননি। মোদ্দা কথা হল, উনিও তো ওটা বই পড়েই শিখেছেন। কোন রোগে কী ওষুধ প্রয়োগ করা উচিৎ, ল্যাবরেটরিতে সে তথ্য আবিষ্কার করেন বৈজ্ঞানিকরা। ডাক্তারবাবু তা রোগীদের ওপর প্রয়োগ করেন মাত্র ।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মাথা ধরা, গায়ে ব্যাথা বা সাধারণ জ্বরে আমরা সচরাচর প্যারাসিটামল্ নামক ওষুধ খেয়ে থাকি । প্যারাসিটামল্ আবিষ্কারের গল্পটা মজার। ভুলবশত একবার একজন রোগীকে ওষুধের সঙ্গে অ্যাসিটানিলাইড খাওয়ানো হয়। অ্যাসিটানিলাইডের গুণাগুণ কেউ তখনও অবধি জানতো না। অ্যাসিটানিলাইড খাওয়ার জন্য রোগীর দেহে সামান্য বিষক্রিয়া হলেও, দেখা গেল রোগীর গায়ের ব্যাথা বেশ কমে গেছে। অর্থাৎ, সামান্য বিষাক্ত অ্যাসিটানিলাইড নতুন ব্যাথা কমানোর একটা ওষুধ। এই অণুর চেহারাটা জানা থাকায়, বৈজ্ঞানিকরা সামান্য অদলবদল করে, প্রায় একইরকম দেখতে অন্য একটা ওষুধ বানালেন, যার বিষক্রিয়া নেই। নতুন ওষুধটার নাম দেওয়া হয়েছিল প্যারাসিটামল। ওষুধ তো বেরোলো, কিন্তু সেটা কাজ করে কী করে? – আবিষ্কার করলেন বৈজ্ঞানিকরা। আমাদের দেহে প্রোস্টাগ্লান্ডিন নামে একধরণের অণু আছে যারা হরমোনের মতো অনেক কাজ করে। একটা কাজ হল, রক্তবাহী ধমনী ও শিরা প্রসারিত করা। কখনও কখনও দরকার হলেও, এর ফলে মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। যদি কোনোক্রমে প্রোস্টাগ্লান্ডিন উৎপাদন কমানো যায় তাহলে মাথার ব্যাথাও কমবে। প্যারাসিটামল ঠিক তা’ই করে। প্রোস্টাগ্লান্ডিন উৎপাদনে সাহায্য করে এমন একটা উৎসেচক বা অনুঘটকের সঙ্গে নিজেকে বিযুক্ত করে প্যারাসিটামল্ প্রোস্টাগ্লান্ডিন উৎপাদন কমিয়ে দেয়। তাই প্যারাসিটামল খেলে আমাদের মাথা ধরাও কমে যায়।
এই রকম নানা রকম রোগের প্রকৃতি নির্ণয় ও তা নিরাময়ের জন্য নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কার করাই বৈজ্ঞানিকদের কাজ। ওষুধ আবিষ্কারে অনেক যন্ত্রপাতি লাগে। তবে প্রধান ব্যাপার হল, ওষুধটা কাজ করছে কিনা জানার জন্য একজন রোগী। একটা উদাহরণ দিই। ব্যাকটেরিয়া মারার ওষুধ আবিষ্কার করার সময় লাগবে ব্যাকটেরিয়া, যার ওপর নতুন আবিষ্কৃত ওষুধটা পরীক্ষামুলক ভাবে প্রয়োগ করে দেখা যাবে ব্যাকটেরিয়া সত্যি সত্যি মরলো কিনা। যদি ক্যানসার সারানোর ওষুধ হয় তাহলে তো আর ক্যানসার রোগীর ওপর ওষুধটা পরীক্ষা করা যাবে না, কেননা তাতে অজানা বিষক্রিয়ায় রোগীর ক্ষতি হতে পারে। ক্যানসারের ওষুধ পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজন ক্যানসারের কোষ। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত ক্যানসার-কোষের অন্যতম ‘হে-লা’ কোষ। হেনরিয়েটা ল্যাকস্ নাম্নী আমেরিকান মহিলার দেহ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল ব’লেই এর নাম হে-লা। শুধু ক্যানসার গবেষণাই নয়, হে-লা কোষ ব্যবহার করে নানা বিষয়ে এগিয়ে গেছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। মিসলস্ বা মাম্পস ভাইরাস কীভাবে কোষে সংক্রামিত হয়, তা যেমন জানা গেছে তেমনই পোলিও ভাইরাসের টিকাও তৈরী হয়েছিল হে-লা কোষ ব্যবহার করেই। যক্ষ্মা বা এইডস্ সম্বন্ধেও আমরা অনেক তথ্য জানতে পেরেছি হে-লা কোষ ব্যবহার করে। হে-লা কোষ ব্যবহার করে হিউম্যান-প্যাপিলোমা-ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার হয়েছে। এমনকি মহাকাশেও পাঠানো হয়েছিল হে-লা কোষকে, মানবদেহে মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাব জানার জন্য। আজও, ভারত ও বাকি বিশ্বের অন্যান্য চিকিৎসা-সংক্রান্ত গবেষণাগারগুলোয়, হে-লা কোষের ব্যবহার অপরিহার্য।
পাঁচ সন্তানের জননী হেনরিয়েটা মাত্র ৩১ বছর বয়সে ক্যানসারে মারা যান ১৯৫১ সালে। এর কিছুদিন আগে জন হপকিন্স হাসপাতালে, চিকিৎসার সময় তাঁর দেহ থেকে পরীক্ষার জন্য কিছু ক্যানসার কোষ সংগ্রহ করা হয়, তাঁর অজান্তেই। তাঁর পরিবারও এ বিষয়ে কিছুই জানতো না। হেনরিয়েটা’র পূর্বপুরুষদের আমেরিকায় আনা হয়েছিল ক্রীতদাস হিসেবে। ক্রীতদাসপ্রথার অবলুপ্তির পরেও আমেরিকায় বহুদিন বর্ণবিদ্বেষ রয়ে যায়। ক্রীতদাসদের বংশধররা স্বাধীনতা পেলেও, শ্বেতাঙ্গদের সমান সামাজিক স্বীকৃতি পেতো না। শুধু তা’ই নয়, বেশিরভাগ অ্যাফ্রো-আমেরিকানরা ছিল ভীষণ গরীব ও মূলস্রোতের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। তাই, হেনরিয়েটা’র কোষ যে বিজ্ঞানজগতে সাড়া ফেলে দিয়েছে তা জানার মত অবস্থা ছিল না তাঁর পরিবারের। হঠাৎ একদিন, ১৯৭০ সাল নাগাদ, হাসপাতাল থেকে ফোন। হেনরিয়েটা’র স্বামীকে হাসপাতাল থেকে ফোনে জানানো হল যে, হেনরিয়েটা এখনও জীবিত, তাদের গবেষণাগারে সংরক্ষিত কোষ হিসেবে। বিস্মিত হয়ে পরিবারের সবাই হাসপাতালে গেলে, তাদেরও ক্যানসার আছে কিনা পরীক্ষা করাতে বলা হল। তারপরে আর কোনো যোগাযোগ নেই। শুধু হেনরিয়েটা’র পরিবারকে না-জানানোর অনৈতিকতাই নয়, এর সঙ্গে অর্থনীতিও জড়িত। হে-লা কোষ বিক্রি করে অনেকেই মোটা টাকা আয় করেছে অথচ গরীব হেনরিয়েটা’র পরিবারের ডাক্তার দেখানোর পয়সাও ধার করতে হয়। এ বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, বই লেখা হয়েছে, যদিও কার কতটা নৈতিক বা আইনী দায়িত্ব, সেই সমাধান হয়নি। যা’ই হোক না কেন, শেষ অবধি একটা কথা কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ১৯৫১ সালে হেনরিয়েটা ল্যাকসের মৃত্যু হলেও তিনি বেঁচে থাকবেন যতদিন পর্যন্ত আমরা হে-লা কোষগুলোকে বিভাজন করিয়ে বাঁচিয়ে রাখবো এই পৃথিবীতে।
Rebecca Skloot-এর লেখা হেনরিয়েটা ল্যাকসের জীবনী “The Immortal Life of Henrietta Lacks” বইয়ে লেখিকা একটা কবিতা লিখেছিলেন, নিজেকে হেনরিয়েটা ল্যাকসের মেয়ে ডেবোরা কল্পনা করে। কবিতাটা এবং অবশ্যই বইটা পড়লে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেপথ্যের গল্প এবং সংশ্লিষ্ট সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলো বেরিয়ে আসে, পরিচিত ছবির অজানা জন্ম-ইতিহাসের মতো।
ডেবোরা’র কথা
যখন কেউ জিজ্ঞাসা করে
যা প্রায়শই উপেক্ষা করা দুষ্কর,
আমি বলি, হ্যাঁ, ঠিক, ঠিকই শুনেছেন,
হেনরিয়েটা ল্যাকস্ আমার মা,
১৯৫১ সালে মারা যান উনি,
জনস্ হপকিন্স হাসপাতাল মায়ের দেহ থেকে
অনেকগুলো কোষ সংগ্রহ করে,
যে কোষগুলো এখনও বিভাজিত হচ্ছে,
বড় হচ্ছে আর ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে
ঠান্ডা হিমঘরে না রাখা পর্যন্ত।
বিজ্ঞান মা-কে ‘হেলা’বলেই জানে।
মা ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বে, চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণাগারগুলোয়,
কম্পিউটারে কম্পিউটারে ও ইন্টারনেটে।
যখন আমি হাসপাতালে চেক-আপের জন্য যাই,
ডাক্তারকে বলি, আমার মায়ের নাম হে-লা।
শুনে সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে,
আমাকে শোনায় কিভাবে মায়ের কোষরাশি
আমার রক্তচাপের ওষুধগুলো, বা
মানসিক বিষাদ কাটিয়ে ওঠার বড়িগুলো তৈরি করতে সাহায্য করেছে,
বা, মা না থাকলে নাকি
চিকিৎসা শাস্ত্রে এমন সব জরুরী আবিষ্কারগুলোই হতই না।
কিন্তু কেন ? তা কিন্তু কেউ বলে না।
শুধু শুনি আমার মাকে নাকি চাঁদে পাঠানো হয়েছিল
অ্যাটম বোমাতেও রাখা ছিল মা,
বা পোলিও টিকা আবিষ্কারে মায়ের অবদান।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না কী করে মা এত কিছু করতে পারলো ?
তবু, মা যে করতে পেরেছ, তাতেই আমি খুশী
কেননা শেষমেষ মা-র অবদান তো অনেকেরই কাজে লেগেছে।
এটা জানতে পারলে মা’ও খুশী হত ভীষণ।
এ সত্ত্বেও, পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে বড্ড অদ্ভূত ঠেকে।
মায়ের কোষরাশি যদি চিকিৎসা শাস্ত্রে এমনই জরুরী হয়
তাহলে কেন তার পরিবারের ডাক্তার দেখানোর পয়সা থাকবে না?
আমি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারি না।
আমাদের অজান্তেই অনেকেই বড়লোক হয়ে গেলো মায়ের কোষ বেচে
অথচ আমরা কানাকড়িও পেলাম না।
এসব ভেবে, রাগে, এমন শরীর খারাপ হয়ে যেত
যে ওষুধ না খাওয়া অবধি তা সারতো না।
এখন আমি আর রাগ করি না, ঝগড়াও নয়,
শুধু জানতে চাই কে ছিল আমার মা।