রাজ্য বিস্তার
(এক কোটি বছর আগে ডোরাকাটা বিড়ালের জন্ম বৃত্তান্ত শুরু হয়। ক্রমশ ভৌগলিক বিস্তারের সঙ্গে বাঘ জঙ্গলের আধিপত্য কায়েম করে। আজ সেই ক্যারিশম্যাটিক প্রাণীটি বিলুপ্তির মুখে। বাঘের রাজকীয় বিস্তার ও বিবর্তনকে ফিরে দেখা নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।)
বাঘ পরিবারের বর্তমান প্রজাতি পাঁচ হলেও বেশ কিছু শতক আগে পর্যন্ত সংখ্যাটা নয় ছিল। জাভান, বালিয়ান, সাউথ চায়না এবং ক্যাস্পিয়ান টাইগার আজ জঙ্গলে বিলুপ্ত বিজ্ঞানের ভাষায় এক্সটিনক্ট ইন ওয়ার্ল্ড। রইলো হাতে পাঁচ। আমুর, রয়াল বেঙ্গল, ইন্দো-চাইনিজ, মালায়ান, সুমাত্রান বাঘ। প্যান্থেরা টাইগ্রিস আল্টাইকা, আমুর বাঘের বিজ্ঞানের নাম। একমাত্র বাঘ যার বাসস্থান বরফাচ্ছন্ন সাইবেরিয়ায়। বাঘেদের সঙ্গে বর্তমান গৃহপালিত বিড়ালের জিনোমের সাদৃশ্য ছিয়ানববই শতাংশ। ২০১৩ সালে কোরিয়ার যুয়ান সাং চু ও গবেষক জন ভাক বাঘের জিন মানচিত্র প্রকাশ করেন নেচার পত্রিকায়। শুধু তাই নয় বাঘের জিনোমের সাথে স্নো লেপার্ড এবং সিংহের জিনোমের তুলনামূলক সাদৃশ্য চমকে দেবার মত। স্নো লেপার্ডদের বরফের সাথে মানিয়ে নিয়ে বেঁচে বর্তে থাকার জন্য রয়েছে ইজিএলএন১ একটি বিশেষ জিন। সাদা সিংহের চামড়ার বর্ণের জন্য দায়ী একটি ছোট মিউটেশন। সিংহের সাথে বাঘের পার্থক্য করতে গিয়ে দেখা যায় বাঘের পেছনের পা দুটি তুলনামূলকভাবে বড়, ফলে বাঘেদের লাফানোর ক্ষমতা প্রায় ১২ ফুট।
বাঘের জন্ম ও ভৌগলিক বিস্তার নিয়ে বিজ্ঞানীরা আজও দুটি দলে বিভক্ত। একটি দলের মতে বাঘের জন্মস্থল সাইবেরিয়ায় প্রায় ২৪ লক্ষ বছর আগে। বরফ যুগের সময় সাইবেরিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায় কমে আসে খাবার, শুরু হয় বাঘেদের দক্ষিণমুখী যাত্রা চিন হয়ে এশিয়া। এই সময় বাঘেরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়। একটি দল ভারতে বাকি দুইটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং কাস্পিয়ান সাগরের অভিমুখে যায়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাঘ গুলো আবারও দুটো ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মালয়েশিয়া, জাভা, বালি ও় সুমাত্রায়। ভৌগলিক বিস্তারের এই ঘটনা চলে প্রায় বারো হাজার বছর আগে পর্যন্ত। তবে এই মতামত এসে ধাক্কা খায় বাঘেদের চামড়ার উজ্জল রঙে এবং ডোরাকাটা দাগে। বাঘেরা যদি সাইবেরিয়াতে জন্ম নেয় তবে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁদের হলদে রঙ এবং ডোরাকাটা দাগ তো থাকার কথা নয়। সেখান থেকেই জন্ম নিল দ্বিতীয় তত্ব, যার মূল কথা বাঘেদের উৎপত্তি পূর্ব এশিয়ায়। দক্ষিণ চীনের বাঘেদের আদিমতম বাঘ হিসেবে ধরে নেওয়া হয় কারণ তাদের খাটো খুলি অন্যান্য বাঘেদের থেকে বেশ আলাদা। বর্তমানে দক্ষিণ চিনের বাঘেদের চোখদুটি অনেকখানি সামনের দিকে এবং দুটো চোখের দূরত্বও বেশ কম। দক্ষিণ চীনের আদিম বাঘেদের দলটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদলের গন্তব্য দক্ষিণ পূর্বে, যাদের থেকে সাইবেরিয়ান টাইগারের উৎপত্তি। অন্য দলটি দক্ষিণ-পশ্চিমে যাত্রা করে ভারতসহ ইন্দোনেশিয়া, বালি, সুমাত্রা, জাভায় ছড়িয়ে পড়ে, এই দলের যাত্রার মাঝপথে পড়ে ক্যাস্পিয়ান সাগর, সেখানে এক নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয় যারা আজ ক্যাস্পিয়ান বাঘ নামে পরিচিত হয় যারা বর্তমানে বিলুপ্ত। তৃতীয় একটি মতও আছে কিছু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন বাঘেদের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়, তবে ধোপে টেকেনি সে ধারণা।
শ্রীলঙ্কায় বাঘ-সিংহের অনুপস্থিতি বেশ খটমটে। সিংহ শ্রীলঙ্কায় ছিল তবে আজ নেই, বাঘও তো শ্রীলঙ্কায় ছিল কিন্তু আজ কেন নেই। শ্রীলঙ্কায় সিংহের বিলুপ্তি ঘটেছে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে, আধুনিক মানুষের শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ আজ থেকে ৩৭ হাজার বছর আগে, যার কয়েক হাজার বছর আগেই সিংহের বিলুপ্তি ঘটেছিল। নটি বাঘের ফসিল উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে শ্রীলঙ্কা থেকে যার মধ্যে চারটি বাঘের কার্বন ডেটিং করে জানা গেছে শ্রীলঙ্কায় ১৫ হাজার বছর আগেও বাঘ ছিল। তারা সম্ভবত ভারতবর্ষ হয়েই শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ করে বরফ যুগের সে সময় জলস্তর কম থাকায় ভারত এবং শ্রীলঙ্কার স্থলযোজক সম্পূর্ণ ছিল। শ্রীলংকার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে না পেরে ধীরে ধীরে অবলুপ্তি ঘটে বাঘের আজ শ্রীলঙ্কায় জঙ্গলে চিতাবাঘ রাজা। (ক্রমশ)