আমরা মানুষেরা নিজেদের পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব বলে মনে করি। কিন্তু সত্যি কী তাই? আমরা যদি এতই শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকি, তবে আমরা অনেকেই কেন বিভিন্নধরনের জেনেটিক রোগে ভুগছি? নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণা, জিনগত পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে আমাদের প্রাথমিক বিকাশের ত্রুটির পরিপ্রেক্ষিতে একটি ব্যাখ্যা প্রদান করে কেন আমাদের পূর্বপুরুষদের লেজ বিলুপ্ত হয়েছিল। সাম্প্রতিক মূল্যায়ন থেকে জানা যায় যে নিষিক্ত ডিমের প্রায় অর্ধেক সংখ্যাও ভ্রূণে পরিণত হয় না আবার ভ্রূণে পরিণত হলেও সব শিশু জন্মগ্রহণ করে না। আমাদের মধ্যে যারা জন্মায়, তাদের মধ্যে ১০%-এর সামান্য কম হিমোফিলিয়ার মতো ‘বিরল’ জেনেটিক রোগে আক্রান্ত হয়। সিকেল সেল রোগ এবং সিস্টিক ফাইব্রোসিসের মতো একটু কম বিরল রোগে আমরা আরও বেশি আক্রান্ত হই। কিন্তু বিবর্তন অনুসারে একটি সফল প্রজাতির ক্ষেত্রে সত্যিই কী এমন হওয়ার ছিল? তবে অগ্রগতি কোথায়?
মানুষ এবং প্রাইমেটের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট পার্থক্য হল যে মানুষের লেজ নেই। প্রায় ২.৫ কোটি বছর আগে মানুষের এই লেজ বিলুপ্ত হয়েছে। এই লেজ বহনকারী বংশ থেকে বিবর্তনের ফলে আমাদের কাছে এখনও ককসিক্স রয়েছে। মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্তে স্যাক্রামের নীচের অংশকে সাধারণত টেল বোন বা ককসিক্স বলা হয়। সাধারণত প্রাইমেটদের ক্ষেত্রে ওই অংশ থেকে লেজ শুরু হয়, তাই হাড়টির নাম টেলবোন। মানুষ সহ যে সমস্ত প্রাইমেটদের লেজ নেই-তাদের ক্ষেত্রে ককসিক্সকে বলা হয় ভেস্টিজিয়াল টেল। তিন থেকে পাঁচটি অপূর্ণাঙ্গ কশেরুকা নিয়েই মূলত ককসিক্স তৈরি হয়। শরীরের সমস্ত ওজন সামলে বসা, দাঁড়ানো ও হাঁটাচলা নিয়ন্ত্রণ করে। সাম্প্রতিক গবেষণা জানিয়েছে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে লেজের বিকাশ ঘটাতে অনেক জিন একত্রিত হয়। গবেষকের দল শনাক্ত করেন যে লেজবিহীন প্রাইমেটদের একটি অতিরিক্ত ‘জাম্পিং জিন’ রয়েছে। জাম্পিং জিন হল এমন ডিএনএর ক্রম যা জিনোমের নতুন এলাকায় স্থানান্তরিত হতে পারে। TBXT নামের একটি জিনে এই সংক্ষিপ্ত ডিএনএ সন্নিবেশ বা ইন্সারশনকে বলা হয় ‘AluY’ যা মানুষ বা সমস্ত বনমানুষদের মধ্যে উপস্থিত থাকলেও অন্যান্য প্রাইমেটদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। AluY-এর জন্য TBXT আরএনএ-র দুটি ফর্ম তৈরি হয়েছে। গবেষকদের মতে এর মধ্যে একটি, লেজের অপসরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দলটি আরও শনাক্ত করেন যে একই প্রাইমেটদের একটি পুরানো কিন্তু অনুরূপ জাম্পিং জিন একটু দূরে TBXT জিনের মধ্যে অবস্থিত ছিল। এই দুটির কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ার প্রভাবে TBXT মেসেঞ্জার আরএনএ-এর প্রক্রিয়াকরণকে পরিবর্তন করে। দুটি জাম্পিং জিন আরএনএ-তে একে অপরের সাথে লেগে থাকার ফলে তাদের মধ্যে থাকা আরএনএ-র অংশটি প্রোটিন কোড করতে পারে না ফলত একটি ছোটো প্রোটিন তৈরি হয়। গবেষকরা ইঁদুরের ক্ষেত্রে একই প্রভাব লক্ষ করেন। গবেষকরা দেখেন জিনের অংশটি বাদ দিয়ে আরএনএ-র আকার যত বেশি হবে, ইঁদুরের লেজ ছাড়া জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। আর একটি অদ্ভুত জিনিস তারা লক্ষ করেন। উক্ত অংশটি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র TBXT জিনের আকার নিয়ে একটি ইঁদুর হলে তার এমন একটি অবস্থা তৈরি হতে পারে যা মানুষের স্পাইনা বিফিডা অবস্থার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। স্পাইনা বিফিডা মানুষের মধ্যে সৃষ্ট এমন এক অবস্থা যখন মেরুদণ্ড এবং সুষুম্না কাণ্ড গর্ভাশয়ে সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে না, একটি ফাঁক তৈরি হয়।
প্রাইমেটের যে দলে গরিলা, শিম্পাঞ্জি এবং মানুষ অন্তর্ভুক্ত তারা আজ থেকে প্রায় আড়াই কোটি বছর আগে লেজ হারিয়েছিল। গবেষকরা বলছেন, লেজের এই অপসরণের ফলে মানুষ সুবিধার সাথে সাথে বেশ কিছু অসুবিধারও সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদের জিন প্রায়শই শরীরের একাধিক ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করে, তাই যে পরিবর্তনগুলো এক জায়গায় সুবিধা সৃষ্টি করে তা অন্যত্র ক্ষতিকারক প্রতিপন্ন হতেই পারে। তাই লেজ হারিয়ে আমরা এখন মেরুদণ্ড সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে ভুগে চলেছি।