শিকার শিকারী অভিযোজন

শিকার শিকারী অভিযোজন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৭ আগষ্ট, ২০২৫

নেকড়ে শাবকেরা সাধারণত জন্মের পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ গুহায় কাটায়। তখন তাদের চোখ ও কান বন্ধ থাকে, তারা চলাফেরা করতে বা সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া দিতে পারে না। এই পর্বে তারা সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষার প্রয়োজনে, মাতৃদুগ্ধের উপর নির্ভরশীল থাকে। তবে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক সংলগ্ন পূর্বাঞ্চলের ঢালে গবেষকদের বসানো রিমোট ক্যামেরাগুলি এই নেকড়েদের এক ব্যতিক্রমী আচরণের চিত্র তুলে এনেছে। দেখা গেছে পূর্ণবয়স্ক নেকড়েরা বরফে ঢাকা ঢালু অঞ্চলে সদ্যোজাত শাবক মুখে করে জায়গাবদল করছে। কিছু ক্ষেত্রে শাবকদের পশ্চাৎদেশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে – যা শিকারি স্তন্যপায়ীদের মধ্যে বিরল ও বিপজ্জনক কৌশল হিসেবে পরিচিত। এই আচরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলির গবেষক ডঃ অ্যাভেরি শলার এবং তাঁর সহকর্মীরা এক নতুন বাস্তবতা উন্মোচন করেন । নেকড়ে গোষ্ঠীগুলি গ্রীষ্মে তাদের গুহা থেকে বহু দূরে শিকারের অনুসরণে যাত্রা করে, এমনকি সেই অভিযানে শাবকদের জায়গাবদল করতেও পিছপা হয় না। গবেষকেরা ১৯টি জিপিএস কলারযুক্ত নেকড়ের চলাচলের তথ্য বিশ্লেষণ করে ৯৯টি পরিযায়ী এল্ক-এর গতিপথের সঙ্গে তুলনা করেন। দেখা যায়, বসন্তকালে যখন গর্ভবতী এল্করা নীচু উপত্যকা থেকে উচ্চ তৃণভূমির দিকে পরিযান করে, তখন কিছু নেকড়ে গোষ্ঠীও সেই শিকারের গতিপথ অনুসরণ করে। এদের কেউ কেউ প্রতি দিন ৬–১২ মাইল দূরে যাত্রা করে শিকারে যায়। আবার কেউ কেউ কয়েক সপ্তাহের জন্য সম্পূর্ণ আবাসস্থল বদল করে। এই জায়গাবদলের পিছনে প্রধান চালিকাশক্তি হল এল্ক শাবক। এরা সহজলভ্য, পুষ্টিকর। স্তন্য দানরত মা নেকড়ে ও বাড়ন্ত শাবকদের জন্য আদর্শ খাদ্য এই এল্ক শাবকগুলি। যদিও নেকড়েরা শাবকদের নিয়ে দীর্ঘ যাত্রায় প্রতিদ্বন্দ্বী নেকড়ে গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাত ও মৃত্যুর ঝুঁকি বহন করে, তথাপি এ ধরনের কৌশল এখনও ইয়েলোস্টোন অঞ্চলে অব্যাহত রয়েছে। ডঃ আর্থার মিডলটন উল্লেখ করেছেন যে এই ফলাফল পুরনো ধারণা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বসন্তকালে পরিযায়ী শিকার প্রাণীরা শিকারির নাগালের বাইরে থাকে কারণ শিকারিরা তখন গুহার মধ্যে আবদ্ধ। বাস্তবে, নেকড়ে একটি “সেলুলার মাইগ্রেশন স্ট্র্যাটেজি” অনুসরণ করছে। সেলুলার মাইগ্রেশন স্ট্র্যাটেজি এমন এক অভিযোজনমূলক চলাচলের পদ্ধতি, যেখানে কোনও প্রাণী গোষ্ঠী (যেমন নেকড়ের দল) পুরোপুরি একসাথে স্থান পরিবর্তন করে না। তারা ভিন্ন ভিন্ন দল বা উপ-দলে (যেন কোষের মতো) বিভক্ত হয়ে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ভিন্ন রাস্তা, গতি এবং সময়ে স্বাধীনভাবে চলাচল করে। আবার মূল গোষ্ঠীর সাথে সংযোগও রাখে। লক্ষনীয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এল্কদের পরিযানের সময়সীমা পরিবর্তিত হচ্ছে। বিগত দুই দশকে তারা শীতকালীন সীমায় প্রায় ৫০ দিন দেরিতে পৌঁছচ্ছে। ফলে নেকড়ে গোষ্ঠীগুলিও নিজেদের পরিযানকে দীর্ঘায়িত করছে। এমনকি পার্ক সীমা ছাড়িয়ে গৃহপালিত পশু পালন ক্ষেত্রেও ঢুকে পড়ছে। এই গবেষণা কেবল নেকড়ের শিকার-সম্পর্কিত আচরণই নয়, বরং বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে শিকারি ও শিকারের জীবনচক্র সংক্রান্ত ছন্দের মিল, জলবায়ু অভিযোজন ও মানুষের সহাবস্থান পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ প্রকৃতিতে অনেক শিকারি প্রাণী এবং তাদের শিকার নির্দিষ্ট মৌসুমি সময়, স্থান, বা জীবনচক্রের ধাপ অনুযায়ী নিজেদের আচরণ বা চলাচল মানিয়ে গুছিয়ে নেয়। যখন শিকার সংখ্যায় বেশি বা দুর্বল (যেমন সদ্যোজাত), তখন শিকারিরাও তাদের গতি ও কর্মকৌশল সেই অনুযায়ী মানিয়ে করে। ডঃ শলার একে “পরিবেশগত পরিবর্তনের চলন্ত ব্যারোমিটার” বলে অভিহিত করেছেন। একটি শিকারি প্রজাতির বিপজ্জনক সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়া বৃহত্তর বাস্তুতন্ত্রের সংকেত বহন করে।

 

সূত্র : Wolves use diverse tactics to track partially migratory prey by

Avery L. Shawler, et.al ; Current Biology(August 01,2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

six − 1 =