শৈশবের আদি অ্যান্টিজেন স্মৃতি  

শৈশবের আদি অ্যান্টিজেন স্মৃতি  

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৫

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস খুব দ্রুত পরিব্যক্তি/মিউটেশন ঘটিয়ে নিজের রূপ বদলায়। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ তাই একই রোগের নানা সংস্করণের মুখোমুখি হয়। কিন্তু মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা আশ্চর্যভাবে প্রথম শেখা পাঠটি কখনও ভোলে না। অর্থাৎ, শৈশবে প্রথম যে ফ্লু ভাইরাসের মুখোমুখি আমরা হই, সেই অভিজ্ঞতা আজীবনের জন্য শরীরে ছাপ ফেলে দেয়। এই বৈশিষ্ট্যকেই বলা হয় অরিজিনাল অ্যান্টিজেনিক সিন (ও এ এস ) বা আদি অ্যান্টিজেন স্মৃতির প্রভাব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নিকারাগুয়া ও নিউজিল্যান্ডে পরিচালিত এক দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রায় ৩,০০০ শিশুর ফ্লু সংক্রমণ, টিকাকরণ ও রোগপ্রতিরোধের বিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছেন। নিকারাগুয়ার রাজধানী মানাগুয়ায় বর্ষাকালে যখন ফ্লু চরমে পৌঁছায়, তখন এপিডেমিওলজিস্ট/মহামারি বিশেষজ্ঞ অবরে গর্ডন ও তাঁর দল শিশুদের সংক্রমণ, টিকাকরণ ও রোগ প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়ার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পরিবর্তন নথিবদ্ধ করেন। উদ্দেশ্য একটাই—শৈশবে প্রথম কোন ফ্লু ভাইরাসের সংস্পর্শে এলে তার প্রভাব আজীবন কীভাবে থেকে যায়, তা বোঝা।

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের গায়ে লেগে থাকা হিমাগ্লুটিনিন (H) ও নিউরামিনিডেজ (N) প্রোটিন নিয়মিত পরিবর্তিত হয়। কিন্তু আমাদের অনাক্রম্য তন্ত্র নতুন ভাইরাস দেখলেও প্রায়ই পুরনো পরিচিত অংশের বিরুদ্ধেই বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই ঘটনাকে বলা হয় ইমিউন ইমপ্রিন্টিং—যেখানে শৈশবের প্রথম সংক্রমণের ছাপ পুরো রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে একটি নির্দিষ্ট পথে চালনা করে।

২০১৬ সালের একটি প্রভাবশালী গবেষণায় দেখা যায়, মানুষের জন্মসাল তার প্রথম ফ্লু সংক্রমণের ভালো সূচক। জন্মসাল অনুযায়ী মানুষ কোন ধরনের ফ্লুতে প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল, তার ওপর ভবিষ্যতের সুরক্ষা অনেকটাই নির্ভর করে। যেমন, যাঁরা শৈশবে ‘গ্রুপ ১’ ফ্লু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁরা পরবর্তীকালে H5N1-এর মতো ভাইরাস থেকে তুলনায় বেশি সুরক্ষা পেয়েছেন। একইভাবে ‘গ্রুপ ২’ ভাইরাসে প্রথম সংক্রমণ ভবিষ্যতের H7N9-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

তবে এই স্মৃতি সব সময় আশীর্বাদ নয়। কখনও কখনও পুরনো স্মৃতি এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে নতুন ভাইরাসের পরিবর্তিত অংশ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয় শরীর। ফলে কিছু বয়সভিত্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে টিকার কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। যেমনটা দেখা গেছিল ২০১৩–১৪ ও ২০১৫–১৬ সালের ফ্লু মরসুমে।

এই দ্বন্দ্ব কাটাতে বিজ্ঞানীরা এখন নতুন প্রজন্মের টিকার দিকে তাকিয়ে আছেন। বিশেষ করে mRNA ভ্যাকসিন, যা একসঙ্গে বহু ধরনের ফ্লু অ্যান্টিজেন শরীরে উপস্থাপন করতে পারে। প্রাথমিক গবেষণায় ইঙ্গিত মিলেছে, এই টিকা পুরনো অনাক্রম্য স্মৃতির বেড়াজাল ভেঙে আরও বিস্তৃত ও শক্তিশালী রোগপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন একটাই—রোগপ্রতিরোধের স্মৃতির নিয়মগুলো কী? বিজ্ঞানীরা আশা রাখেন এই ধরণের গবেষণাই হয়তো সেই নিয়ম উন্মোচনের চাবিকাঠি, যা ভবিষ্যতে একটি সর্বজনীন ও দীর্ঘস্থায়ী ফ্লু টিকার পথ প্রশস্ত করবে।

 

সূত্র :Immunological sin: how a person’s earliest flu infections dictate life-long immunity by Amanda B. Keener, 17th December 2025. This article is part of Nature Spotlight: Influenza.

doi: https://doi.org/10.1038/d41586-025-03606-3.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 1 =