সুমেরু বসন্তে পাখিদের অভিযোজন

সুমেরু বসন্তে পাখিদের অভিযোজন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আর্কটিক/ সুমেরু অঞ্চল বরাবরই প্রকৃতির চরম বৈপরীত্যের নিদর্শন। বছরের বেশিরভাগ সময় বরফ ঢাকা এই ভূমি গ্রীষ্মের অল্প কয়েক সপ্তাহে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বরফ গলতেই মৃত্তিকা ভরে ওঠে পোকামাকড়, গাছপালা ও অফুরন্ত খাদ্যে। এই অল্পস্থায়ী প্রাচুর্যই দূরদেশ থেকে আসা অভিবাসী পাখিদের জন্য বংশবিস্তার ও টিকে থাকার একমাত্র ভরসা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বসন্ত ঋতুর আগমনের সময় এখন দ্রুত এগিয়ে আসছে, আর পাখিরা টিকে থাকার লড়াইয়ে বাধ্য হচ্ছে তাদের প্রাচীন অভিবাসন যাত্রার সময় ও পথ বদলাতে।
আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট অব ইকোলজির গবেষকরা ৫০০টিরও বেশি বসন্তকালীন অভিবাসনের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এই গবেষণাটি মূলত হয় পাঁচ প্রজাতির ওপর – ব্রেন্ট গিজ, বার্নাকল গিজ, গ্রেটার হোয়াইট-ফ্রন্টেড গিজ, পিঙ্ক-ফুটেড গিজ ও বিউইকস সোয়ান। উচ্চপ্রযুক্তি জিপিএস ট্র্যাকিং এবং শরীরের ওজন সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি তথ্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখেন, অনেক পাখি এখন দ্রুত খাবার জোগাড় করে যাত্রার সময় কমিয়ে ফেলছে। কেউ কেউ তাদের উড়ানের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির ৩০% কমাতে সক্ষম হয়েছে, ফলে তারা কয়েক সপ্তাহ আগেই সুমেরুতে পৌঁছে যাচ্ছে। মুশকিল হল সব প্রজাতি একইভাবে খাপ খাওয়াতে পারছে না। হোয়াইট-ফ্রন্টেড গিজ ও বিউইকস সোয়ান সবচেয়ে দক্ষতার সঙ্গে বসন্তের তালে তাল মিলিয়ে উড়তে পারছে। অন্যদিকে পিঙ্ক-ফুটেড ও ব্রেন্ট গিজ সমস্যায় পড়ছে, কারণ দীর্ঘ উড়ান আর সীমিত যাত্রাবিরতি তাদের আগেভাগে পৌঁছানোয় বাধা দিচ্ছে।
একটা বিষয় স্পষ্ট যে, অভিযোজন শুধু প্রজাতির ক্ষমতার উপর নির্ভর করে না। তাদের যাত্রাপথের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও নিরাপদ বিশ্রামের জায়গার উপস্থিতিও বড় ভূমিকা পালন করে।
অভিবাসী পাখিদের জীবনে সময়ই সবকিছু। বরফ গলে অল্প সময়ের জন্য যে খাদ্যের ভাণ্ডার উন্মুক্ত হয়, সেটিই তাদের বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার অপরিহার্য উপাদান। সামান্য দেরি মানেই খাবারের অভাব, দুর্বল ছানা, আর অকালে দক্ষিণমুখী দীর্ঘ যাত্রার মুখোমুখি হওয়া। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মেলানোটা তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। কিন্তু দ্রুত যাত্রারও মূল্য আছে। অতিদ্রুত শক্তি সঞ্চয় করতে হলে দরকার সমৃদ্ধ খাবার ও শান্ত পরিবেশ, যা সবসময় পাওয়া যায় না। আগেভাগে পৌঁছালেও শরীর যদি দুর্বল থাকে, তবে প্রজননে সাফল্য কমে যায়।

গবেষকরা অনুমান করছেন, পাখিরা বর্তমান গতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আরও ১৮ থেকে ২৮ বছর তাল মিলিয়ে চলতে পারবে। এরপর সুমেরু বসন্তের গতি হয়তো তাদের অভিযোজন ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাবে। তখন হয়তো নতুন কৌশল আবশ্যিক হয়ে উঠবে। যেমন শীতকালীন আবাস বদলানো বা অভিবাসন পথ পাল্টানো।
এই গবেষণা একদিকে আশাব্যঞ্জক, কারণ এটি প্রমাণ করে যে পাখিরা অভিযোজনক্ষম, কিন্তু সময় সীমিত। আবার অন্যদিকে এটি সতর্কবার্তাও বটে। জলবায়ু পরিবর্তন এত দ্রুত ঘটছে যে এই নমনীয়তা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়। সুমেরু অঞ্চল একসময় ছিল অভিবাসী পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে তারা হয়তো বাধ্য হবে তাদের প্রাচীন যাত্রাপথ ছেড়ে নতুন করে পথ দেখতে । এ লড়াই শুধু পাখিদের নয়, পৃথিবীর সম্পূর্ণ জীবজগতেরই অভিযোজনের প্রতিচ্ছবি। জলবায়ু পরিবর্তনের গতির সঙ্গে টিকে থাকার দৌড়ে সবাই জড়িত।

সূত্র: scope for waterfowl to speedup migration to a warming Arctic by Hans Linssen ; published in journal Nature climate change (9.09.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × two =