স্বর্গদ্বারের ‘ভার্টিক্যাল ইকোলজি’

স্বর্গদ্বারের ‘ভার্টিক্যাল ইকোলজি’

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৪ মে, ২০২৫

দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের বনপাহাড়ের বুক চিরে একটি রহস্যময় ‘হাঁ করা’ গহ্বর উঁকি দেয়। পৃথিবী যেন এখান দিয়েই তার শ্বাস-প্রশ্বাস বজায় রেখেছে। জিয়াওঝাই তিয়ানকেং হল পৃথিবীর বৃহত্তম সিঙ্কহোল বা প্রাকৃতিক গিরিখাত। কথিত আছে, এটি ড্রাগনের পাতাল দরজা, যেখান থেকে স্বর্গের আলো পড়ে। স্থানীয়রা এটিকে ‘স্বর্গদ্বার ‘ ও বলে থাকেন। কিন্তু ভূতত্ত্ববিদদের চোখে, এটি এক মহাকাব্যোপম ভূ-প্রক্রিয়ার অক্লান্ত চিহ্ন। ১৯৯৪ সালে ব্রিটিশ গুহা অভিযাত্রীদের দল যখন এই গর্তের মুখোমুখি দাঁড়ায় তখন এটি ছিল বিজ্ঞানের কাছে এক বিশাল অজানা মহাদেশ। ২১৭২ ফুট গভীর এই গহ্বরে লম্বালম্বি ভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে ছয়টি কি তারও বেশি ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’। এর আয়তন ৪.২ বিলিয়ন ঘনফুট। এটি একটি প্রাকৃতিক গিরিখাত, যার প্রতিটি ইঞ্চি ইতিহাসে মোড়া। ১ লাখ ২৮ হাজার বছর ধরে, কার্বন ডাই অক্সাইড মিশ্রিত বৃষ্টির ফোঁটা সেই ট্রায়াসিক চুনাপাথরের গায়ে পড়ে কাটাকুটি চালিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে, পাথরও যেন ক্লান্ত হয়ে তার ছাদ ধসিয়ে দেয় আর জন্ম নেয় এই বিরাট গিরিখাতের। চুনাপাথর আর জলের আঁকিবুকিতে গঠিত হয়েছে এক গভীর পৃথিবী।
এই খাতের গভীর ভাগ এবং উপরের ভূ সাদৃশ্য খুব স্পষ্টভাবে আলাদা। উপরে যেখানে গরম, শুষ্ক মালভূমি সেখানেই গভীরে রয়েছে আর্দ্র, সবুজ জগৎ। তার ভেতরে ঝুলছে সবুজ কুয়াশা, শ্যাওলা, ফার্ন, জিঙ্কগো গাছ। বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে বিরল ডানাওয়ালা পোকা, আর স্ফটিকস্বচ্ছ জলাশয়ে ডিম পাড়ছে উভচর প্রাণী। একে বলে ভার্টিক্যাল ইকোলজি। অর্থাৎ একটি বাস্তুতান্ত্রিক স্তরবিন্যাস, যেখানে জীববৈচিত্র্য বা বাস্তুতন্ত্রটি লম্বালম্বি, বিভিন্ন স্তরে ভাগ হয়ে রয়েছে। আর প্রতিটি স্তরে রয়েছে একটি স্বতন্ত্র পরিবেশ, জীবনধারা এবং জীবগোষ্ঠীর অস্তিত্ব। বিজ্ঞানীরা সেন্সর নমুনা সংগ্রাহক, রেডার, মাইক্রোক্লাইমেট লগার সব কিছু নিয়ে নেমে যান অজানার বুক চিরে জ্ঞানের সন্ধানে। জিয়াওঝাই যেন এক জীবন্ত পরীক্ষাগার। এখানে জলের গতি বুঝে আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। চুনাপাথরের গায়ে খোদাই করা যায় ভূগর্ভস্থ মানচিত্র।
কিন্তু এখনও এই গিরিখাত সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি। নীচের নীরবতা ভিন্ন এক স্তরের। শুধু ফোঁটা ফোঁটা জল, আর বাদুড়ের পাখার শব্দ। এ শুধু কিংবদন্তি নয়! জিয়াওঝাই তিয়ানকেং হল সেই জায়গা যেখানে ভূবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, জলবিদ্যা এমনকি পুরাণ একে অপরের সঙ্গে নীরব সংলাপে জড়িয়ে পড়ে। একে ঘিরে বিজ্ঞানীরা এক যুগ ধরে কাজ করছেন, জলপ্রবাহের হার পর্যবেক্ষণ করছেন, গুহার নিচে বর্ষার প্রতিধ্বনি খুঁজছেন। এটি দেখলে অবাক হতে হয় যে জল, পাথর আর সময় কীভাবে মিলে মিশে গঠন করে এক বিরাটাকার গহ্বর যা জানান দেয়, পৃথিবী এখনও বেঁচে আছে, বদলাচ্ছে, আর গোপনে গল্প বলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 4 =