অকালপ্রয়াত গণিতপ্রতিভা মরিয়ম মির্জাখানি 

অকালপ্রয়াত গণিতপ্রতিভা মরিয়ম মির্জাখানি 

সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়
বিজ্ঞানভাষ সম্পাদকীয় বিভাগ
Posted on ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বড় বড় কাগজে সমীকরণ আঁকতেন তিনি। তিনিই ইতিহাসে প্রথম নারী যিনি গণিতের সর্বোচ্চ সম্মান লাভ করেন। কিন্তু মাত্র ৪০ বছর বয়সেই থেমে যায় তাঁর জীবন। মরিয়ম মির্জাখানি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭৭ সালে, ইরানের তেহরানে। বিপ্লবের ঠিক আগেই। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধের মধ্যেই কেটেছে তাঁর শৈশব। ছোটবেলায় কিন্তু তিনি গণিতবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। হতে চেয়েছিলেন লেখক। সংখ্যার চেয়ে গল্পের প্রতিই ছিল তাঁর আগ্রহ। পরিস্থিতি বদলায় ধীরে ধীরে। গণিতপ্রেমী এক ভাই ও ফারজানেগান স্কুলের এক শিক্ষক তাঁর মধ্যে ব্যতিক্রমী প্রতিভা লক্ষ্য করেন। সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক জেতেন। পরের বছর আবার অংশ নিয়ে অর্জন করেন নিখুঁত স্কোর। তিনি প্রতিটি সমস্যা সমাধান করেছিলেন সম্পূর্ণ ঠিকভাবে। এরপর তেহরানের শরীফ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি পিএইচ.ডির জন্য যান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কার্টিস ম্যাকমালেন। তিনি নিজেও ফিল্ডস মেডেলপ্রাপ্ত গণিতবিদ। তাঁর তত্ত্বাবধানে মরিয়ম কাজ করেন হাইপারবোলিক ও রিম্যান পৃষ্ঠ এবং সেগুলির ‘মডিউলি স্পেস’ নিয়ে। আধুনিক জ্যামিতির অন্যতম জটিল ও বিমূর্ত ক্ষেত্র এই ‘মডিউলি স্পেস’। মরিয়মের গবেষণার লক্ষ্য ছিল, শুধু কোনো একটি সমস্যার সমাধান নয়, তিনি জানতে চেয়েছিলেন, জ্যামিতিক কাঠামো কীভাবে পরিবর্তিত হয়, একে অন্যের সঙ্গে কিভাবে যুক্ত থাকে এবং বৃহত্তর গাণিতিক বাস্তবতায় কীভাবে সেগুলি কাজ করে ! ২০০৮ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তখনই এমন সব সমস্যার উপর কাজ করছিলেন যেগুলি কয়েক দশক ধরে অমীমাংসিত ছিল। তাঁর কাজের ধরনও ছিল অনন্য। প্রতীক আর সূত্রের পাশাপাশি তিনি ছবি আঁকতেন। বড় বড় কাগজে জ্যামিতিক নকশা এঁকে মেঝেতে ছড়িয়ে দিতেন। বিমূর্ত গাণিতিক ধারণাকে তিনি দৃশ্যমান রূপ দিতেন। তাঁর মেয়ে একসময় ভেবেছিল, মা বুঝি ছবি আঁকছেন।

২০১৪ সালে মরিয়ম মির্জাখানি ইতিহাস গড়েন। তিনি ফিল্ডস মেডেল পান। ৭৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী এই সম্মান পেলেন, প্রথম ইরানি গণিতবিদও বটে । ইরানে তাঁর সাফল্য হয়ে ওঠে জাতীয় গর্বের বিষয়। বিশেষ করে কিশোরী মেয়েদের জন্য এক নতুন অনুপ্রেরণা। তবে এই সাফল্যের আড়ালেই চলছিল ব্যক্তিগত লড়াই। ২০১৩ সালে তাঁর স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে। দীর্ঘ চিকিৎসা, শরীরের উপর অসহনীয় শারীরিক চাপ, সবকিছুর মধ্যেও তিনি গবেষণা চালিয়ে গেছেন। অসুস্থতার মধ্যেও তিনি গবেষণা চালিয়ে যান। ছাত্রদের পথ দেখান এবং নতুন গাণিতিক প্রশ্ন নিয়ে কাজ করেন। নিজের কাজ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মরিয়াম মির্জাখানি প্রায়ই বলতেন, গণিত অনুসন্ধান যেন অনেকটা উপন্যাস লেখার মতো। শুরুটা হয় কুয়াশা আর বিভ্রান্তিতে, তারপর ধীরে ধীরে সংযোগগুলো স্পষ্ট হয়, আর একসময় আড়ালে থাকা একটি কাঠামো উন্মোচিত হয়। তাঁর ভাষায়, “গণিতের সৌন্দর্য কেবল ধৈর্যশীল অনুসারীদের কাছেই ধরা দেয়।” ২০১৭ সালের ১৪ জুলাই, মাত্র ৪০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। বিশ্বজুড়ে গণিতসমাজ শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় শোক প্রকাশ করে। শোক প্রকাশ করে তার দেশ ইরানও। তেহরানে সংবাদপত্রগুলিতে তাঁর ছবি ছাপা হয়। তাঁর প্রতিভা রাজনৈতিক ও সামাজিক সীমারেখা ছাপিয়ে গিয়েছিল। ইরান সরকার তাঁর জন্মদিন, পারসিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১২ই মে কে ‘জাতীয় নারী গণিত দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। তেহরানের একটি মেয়ে একদিন এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, যেখানে আগে কোনো নারী পৌঁছাননি। অল্প জীবনে মির্জাখানি যা অর্জন করেছেন, তা অনেকের সারাজীবনের কাজের চেয়েও বেশি। তিনি শুধু গণিতে নারী–পুরুষের ভেদরেখা ভাঙেননি, সেই বাধাকেই চিরতরে দুর্বল করে দিয়েছেন। তাঁর উপপাদ্য আজও অটল। তাঁর প্রমাণগুলি এখনও গবেষকদের পথ দেখায়। শিক্ষার্থীরা এখনও তাঁর কাজ দেখে। তাঁর সমাধানগুলির নান্দনিক সৌন্দর্য বিস্মিত করে। তেহরানে কিংবা পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে, কোনো তরুণী, মির্জাখানির গল্প পড়ে বুঝতে পারে, কোনো ক্ষেত্রে ‘প্রথম নারী’ হওয়া অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন শুধু নতুনভাবে ভাবার সাহস এবং সেই ভাবনাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার দৃঢ়তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 − 4 =