অচেনা রোগের জিনঘটিত চিকিৎসা

অচেনা রোগের জিনঘটিত চিকিৎসা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৪ অক্টোবর, ২০২৫

বছরের পর বছর ধরে শিশুদের এক অচেনা শারীরিক সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছিল। যেমন হঠাৎ হঠাৎ শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে, যকৃত ক্ষয়ে যাচ্ছে, মাংসপেশি ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে । কিন্তু কোনো চিকিৎসকই কি ঘটছে সেটা ধরতে পারছিলেন না। ফলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছিল। রোগটি এতটাই বিরল যে এর অস্তিত্ব নিয়েই চিকিৎসকরা সন্দিহান ছিলেন । এই বিভ্রান্তি আর দীর্ঘ চিকিৎসাজনিত অনিশ্চয়তা আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকদের অসহায় করে তুলেছিল।
অবশেষে ডিউক-এনইউএস মেডিকেল স্কুলের নেতৃত্বে এক আন্তর্জাতিক গবেষণা দল এই অচেনা রোগটির আসল রহস্য উদ্ঘাটন করল। তাঁরা আবিষ্কার করলেন SPNS1 নামের এক জিনের অপ্রত্যাশিত পরিব্যক্তিই এই রোগের মূল কারণ। আমাদের প্রতিটি কোষের ভেতরে আছে লাইসোজোম যা কোষের রিসাইক্লিং সেন্টার হিসেবে কাজ করে। পুরনো চর্বি ও কোলেস্টেরলকে ভেঙে আবার ব্যবহারযোগ্য করে তোলাই এদের কাজ। কিন্তু SPNS1 জিন ত্রুটিগ্রস্ত হলে ভাঙা চর্বি ও কোলেস্টেরল আর কোষ থেকে বেরোতে পারে না। ফলে এই ভাঙা অণু জমতে জমতে কোষ ধ্বংস করতে শুরু করে – প্রথমে লিভার, পরে মাংসপেশি। রোগী ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে, শরীর ভেতর থেকে আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যেতে থাকে।
এই নতুন রোগটিকে লাইসোজোমাল স্টোরেজ ডিজিজ গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেখানে ইতিমধ্যেই ৭০টিরও বেশি বিরল রোগ চিহ্নিত আছে। গবেষক দলটি দুটি পরিবারের শিশুদের পরীক্ষা করে এই রহস্যের সমাধান পায়। সেক্ষেত্রেও আক্রান্ত শিশুদের যকৃতের অসুখ, মাংসপেশির দুর্বলতা ইত্যাদি অস্পষ্ট উপসর্গ ছিল। তাদের জিনগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, তাদের শরীরে SPNS1 জিনের উভয় অ্যালিলই ক্ষতিগ্রস্ত।
গবেষক হে মেংলান বলেছেন, কোষের ঝিল্লি বা মেমব্রেন গঠনের মূল উপাদান হল ফসফোলিপিড। সাধারণত SPNS1 এই ভাঙা ফসফোলিপিডকে পুনঃব্যবহারের জন্য বাইরে নিয়ে আসে। কিন্তু যাদের জিনটির পরিব্যক্তি একবার ঘটে যায় তাদের ক্ষেত্রে এই পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়, ফলে কোষ ধ্বংস হতে শুরু করে।
আরও বিশেষ বিষয় হলো, কোষ পর্যাপ্ত পুষ্টি না পেলে এই সমস্যা আরও গুরুতর আকার নেয় । অর্থাৎ SPNS1 জিন শুধু চর্বি পুনঃব্যবহারেই নয়, কোষের শক্তিগত ভারসাম্য ধরে রাখার ক্ষেত্রেও অপরিহার্য।
ডিউক-এনইউএস–এর অধ্যাপক ডেভিড সিলভার বলেন, SPNS1 প্রতিটি কোষে কাজ করে এবং এটি শুধু বিরল এই রোগ নয়, বরং ক্যানসারের মতো আরও অনেক জটিল রোগ বোঝার ক্ষেত্রেও নতুন করে পথ দেখাতে পারে।
এই আবিষ্কারের একটা মানবিক দিকও আছে। গবেষকরা বর্তমানে N = 1 Collaborative–এর সঙ্গে কাজ করছেন, যাতে আক্রান্তদের জন্য ব্যক্তিগত জেনেটিক থেরাপি তৈরি করা যায়। লেইডেন ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের ড. মারলেন লাওফার জানান, তারা এখন চেষ্টা করছেন কিভাবে ত্রুটিপূর্ণ চর্বি পরিবহন প্রক্রিয়াকে জিন চিকিৎসার মাধ্যমে ঠিক করা যায়।
অভিভাবক দালিলা সাবারেদজোভিচ, যিনি আক্রান্ত দুই শিশুর মধ্যে একজনের মা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন,“আমরা এতদিন যেন অন্ধকারে হেঁটে চলছিলাম। এখন মনে হচ্ছে সামনে আলো দেখা যাচ্ছে। এই গবেষণা আমাদের শুধু আশাই দেয়নি, আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ রক্ষার লড়াইয়ে নতুন ভরসা দিয়েছে।”
অধ্যাপক প্যাট্রিক ট্যান এটিকে প্রিসিশন মেডিসিনের জোরালো উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, বিরল উপসর্গ থেকে নির্দিষ্ট জিন শনাক্ত করা এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরি করা – এটাই হল আধুনিক চিকিৎসার শক্তি। এই গবেষণা শুধু ওই পরিবারগুলোর জন্য নয়, বরং সমগ্র চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য এক নতুন দিকনির্দেশনা।

সূত্র: “SPNS1 variants cause multiorgan disease and implicate lysophospholipid transport as critical for mTOR-regulated lipid homeostasis” by Menglan He, Mei Ding,et.al;(2.09.2025), The Journal of Clinical Investigation.
DOI: 10.1172/JCI193099

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

9 − 3 =