
বছরের পর বছর ডেনিসোভানদের নিয়ে যা কিছু কল্পনা করা হত তা কেবল তাদের ডিএনএ পর্যায়ক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন এক বিশাল করোটি উদ্ধার হওয়ার পর ওই মানবগোষ্ঠীকে বাস্তব অবয়বের কাছাকাছি আনা সম্ভব হয়েছে। এই করোটিকে গবেষকরা এক দৈত্যাকার মানবপ্রজাতির নিদর্শন বা ড্রাগন ম্যান হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ২০১০ সালে সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহা থেকে একটি আঙুলের হাড়ে প্রথম শনাক্ত হয় ডেনিসোভান ডিএনএ। তখন কেউ জানত না এই গোষ্ঠীর চেহারা কেমন ছিল। আজ হারবিন শহরে পাওয়া এই ১ ফুট লম্বা করোটি ডেনি রহস্যে আলোর ঝলক ফেলেছে। হাড়টির বয়স কমপক্ষে ১,৪৬,০০০ বছর। দাঁতের উপর জমে থাকা শক্ত হলুদ বা বাদামী রঙের ময়লা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বের করেছেন প্রাচীন মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ এবং ৯৫টি প্রোটিন। এর মধ্যে ৩টি প্রোটিন এমনই যা কেবল ডেনিসোভানদের মধ্যেই দেখা যাওয়ার কথা। এই আণবিক সাক্ষ চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে গবেষকদের ‘ড্রাগন ম্যান’ই আসলে ডেনিসোভান। এর আগে এই করোটিকে ‘হোমো লঙ্গি’ নামে আলাদা প্রজাতি হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু বর্তমান জিন তত্ত্বভিত্তিক গবেষণা বলছে, এটি আসলে ডেনিসোভানদেরই অন্তর্গত এক অনন্য বৈচিত্র্য, কোনো আলাদা প্রজাতির নমুনা নয়। এই করোটি সম্ভবত ২,১৭,০০০ থেকে ১,০৬,০০০ বছর আগের, যখন ডেনিসোভানরা এশিয়ার উত্তর-পূর্বে থাকত। সে সময় এরা নিয়ান্ডারথাল ও প্রাচীন হোমো স্যাপিয়েনসদের পাশেই বাস করত ।
শরীর ছিল দৈত্যাকৃতি। গবেষক বেন্স ভিওলার অনুমান, এদের ওজন ছিল ১০০ কেজির কাছাকাছি। এই বিশাল দেহের পুষ্টি হিসেবে তাদের প্রতিদিন লাগত ৪০০০ ক্যালোরি শক্তি। তাই তারা হয়তো মরু ও তুন্দ্রা অঞ্চল জুড়ে শিকার করত হরিণ ও ঘোড়া বা ওই জাতীয় প্রাণীদের, আর মরশুম বদলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত এখান ওখান। আজও আধুনিক মানুষের জিনে আছে ডেনিসোভানদের ছাপ। পাপুয়া নিউগিনি বা তিব্বতের উচ্চভূমির মানুষের শরীরে রয়েছে তাদের জিনের অংশ, যা তাদের উচ্চ স্থানে অক্সিজেন ব্যবহারে সহায়তা করে। এমনকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা চর্বি বিপাক প্রভৃতি ব্যাপারেও এই পূর্বপুরুষদের অবদান স্পষ্ট। এই করোটির বিশ্লেষণ এখন প্রশ্ন তুলছে, চীনের অন্যান্য মানব জীবাশ্ম, যথা দালি বা হুয়ালংডং, তারা কি আলাদা প্রজাতি, নাকি ডেনিসোভানদেরই আঞ্চলিক বৈচিত্র্য মাত্র? আজ গবেষকরা ত্রিমাত্রিক ডিজিটাল মডেলে এই ড্রাগন ম্যানের খুলি ও জিন ঘটিত উপাত্ত মিলিয়ে তাদের হাঁটা, কথা বলা, সামাজিক আচরণ সম্বন্ধে ধারণা গড়ে তুলছেন। যদি সফল হন, তাহলে শুধু ইতিহাসই নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানও উপকৃত হবে এই প্রাগৈতিহাসিক উপাত্ত থেকে। ‘ড্রাগন ম্যান’ যেন সেই লুপ্ত অধ্যায়ের শুরু যা আমাদের মধ্যেই বেঁচে আছে।