অতিফলন বনাম মাটির স্বাস্থ্য

অতিফলন বনাম মাটির স্বাস্থ্য

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২০ অক্টোবর, ২০২৫

আধুনিক কৃষি উৎপাদন বলতে এখন আমরা বুঝি উচ্চফলনশীল বীজ ,সার, সেচ ও উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একই জমি থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি ফলন তোলা। কিন্তু সম্প্রতি এক নতুন গবেষণা সতর্ক করছে, এই অতিরিক্ত ফলনের নেশা আস্তে আস্তে মাটির প্রাণশক্তি ও সহনক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক খাদ্যশৃঙ্খলে বড় বিপদ ঘটতে পারে।
মাটির সহনক্ষমতা বলতে বোঝায় সেই ক্ষমতা, যা তাকে খরা, অতিবৃষ্টি বা জলবায়ু পরিবর্তন প্রভৃতি ধাক্কার পরও পুনরুদ্ধার হতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন এই শক্তি ক্ষয় হতে থাকে, জমি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং প্রতি ঋতুতে মাটির পুনরুদ্ধার আরও কঠিন হয়ে যায়।
ড. অ্যালিসন কার্সওয়েলের নেতৃত্বাধীন ব্রিটেনের রোথামস্টেড রিসার্চের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চাষ, সার প্রয়োগ, কীটনাশক ব্যবহার, ও মাত্রাতিরিক্ত সেচকার্য প্রথমে উৎপাদন বাড়ালেও দীর্ঘমেয়াদে মাটির প্রাকৃতিক স্থিতি নষ্ট করে দেয়। এই প্রক্রিয়াগুলো একধরনের প্রতিক্রিয়া চক্র তৈরি করে, যা হয় মাটিকে সুস্থ রাখে, নয়তো বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। অর্থাৎ, যত বেশি চাষ, তত বেশি ক্ষয়, তত কম পুনরুদ্ধার।
মাটি পৃথিবীর প্রায় ৯৫% খাদ্য উৎপাদনের ভিত্তি, এবং এতে রয়েছে প্রায় ১,৭০০ গিগাটন কার্বন, যা সব জীবন্ত উদ্ভিদের মোট কার্বনের স্থিতিকরণের চেয়েও ঢের বেশি। কিন্তু জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফ এ ও) জানায়, বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মাটি ইতিমধ্যেই অবনমিত হয়েছে ক্ষয়, দূষণ ও পুষ্টির ভারসাম্যহীনতার কারণে।
মাটির ভারসাম্যের ছন্দপতন হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো— অতিরিক্ত চাষ, অরণ্যবিনাশ ও পুড়িয়ে ফেলা, অতিরিক্ত পশুচারণ, এবং খনিজসমৃদ্ধ জলের সাহায্যে পুনঃসেচ যা মাটিকে অতিরিক্ত লবণাক্ত করে চাষের অনুপযুক্ত করে দেয়। এফ এ ও -এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের প্রায় ১০% সেচকৃত জমি এখন লবণাক্ত – একপ্রকার দূষিতই বলা ভালো। সেটা হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আরও বাড়তে পারে।
অতিরিক্ত কীটনাশক ও প্লাস্টিকের ব্যবহার মাটির উপকারী অণুজীব ও গঠনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে, মাইক্রোপ্লাস্টিক জমে মাটির ছিদ্র দিয়ে জল চলাচল ও উর্বরতা কমিয়ে দেয়।
তবে আশার দিকও আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সংরক্ষণমূলক কৃষি পদ্ধতি, কভার ক্রপ (মাটি ঢাকা দিয়ে আর্দ্রতা ও পুষ্টি ধরে রাখা), এবং কীট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মাটির গঠন পুনরুদ্ধারে সহায়ক। এছাড়াও, লাইমিং/ চুন জাতীয় ক্ষারীয় পদার্থ প্রয়োগ করলেও ভালো ফল পাওয়া যায়।
যথা -১) মাটির পি এইচ বাড়িয়ে অতিরিক্ত অম্লত্ব প্রশমন করা যায় ।
২) উদ্ভিদ সহজে নাইট্রোজেন-ফসফরাস-পটাশিয়াম (এন পি কে) এবং অন্যান্য খনিজ উপাদান শোষণ করতে পারে।
৩) মাটির স্বাস্থ্য ভালো হয়।
৪)ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
ইউ এস ডি এ জানায়, এক ইঞ্চি শীর্ষস্তরীয় মাটি গঠনে প্রায় ১,০০০ বছর লাগে। কাজেই একবার মাটি নষ্ট হলে সেটির পুনরুদ্ধার মানুষের জীবদ্দশায় প্রায় অসম্ভব। তাই গবেষকরা সতর্ক করছেন, কৃষির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণে।
মাটি শুধু ফসলের ভিত্তি নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার মূলভিত্তিও বটে। তাই নীরবে ক্রন্দনরতা মৃত্তিকাকে অবিলম্বে বাঁচানো মানে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের অন্নসংস্থান তথা ভবিষ্যৎ-কে রক্ষা করা।

সূত্র: Agricultural practices can threaten soil resilience through changing feedback loops by Alison M. Carswell, Simon Willcock,et.al; published in npj Sustainable Agriculture,(1.10.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × four =