মঙ্গলের রুক্ষ লাল পৃষ্ঠ আজ প্রাণহীন, শুষ্ক ও ধূলিধূসর। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই দৃশ্য সবসময় এমনটা ছিল না। নতুন এক গবেষণায় জানা গেছে, মঙ্গল এক সময় বরফে ঢাকা ছিল। আর সেই বরফের বহু নিদর্শন আজও মঙ্গলের মাটির নীচে চাপা আছে। তবে এই বরফই ভবিষ্যতের মানব মঙ্গল অভিযানের জন্য ‘জীবনদায়ী সম্পদ’ হতে পারে। গবেষক দলটি উচ্চ-নির্দেশাঙ্ক বিশিষ্ট কক্ষপথচিত্র ও উপগ্রহ তথ্য বিশ্লেষণ করে মঙ্গলের বিভিন্ন গহ্বর বা “ক্রেটার”-এর ভেতরে কিছু অদ্ভুত ভূ-আকৃতি শনাক্ত করেছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘মরাইন’ অর্থাৎ বরফ গলে সরে যাওয়ার পর জমে থাকা আবর্জনা স্তর। ঢালু পাহাড়ের মতো বরফ-সৃষ্ট ভাঁজ, এবং অদ্ভুত শিলাস্তূপ। এগুলি একসময় বরফের প্রবাহের ফলে তৈরি হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই সমস্ত চিহ্ন বিশেষত ২০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত গহ্বরগুলিতে পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই অঞ্চলগুলির ছায়াচ্ছন্ন দেয়াল বরফ সংরক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক ফ্রিজারের মতো কাজ করে। সেখানে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে না, ফলে বরফ গলবার সম্ভাবনাও কম। অনুমান করা যাচ্ছে, মঙ্গলে একাধিক বরফাচ্ছন্ন যুগ এসেছিল। প্রাচীনতম বরফের গঠনটি প্রায় ৬৪ কোটি বছর আগেকার। সাম্প্রতিকতম চিহ্নটি প্রায় ৯ কোটি ৮০ লাখ বছরের পুরনো। প্রতিটি শীতল যুগের শেষে বরফ ধীরে ধীরে গলে গেছে। প্রতিটি পরবর্তী যুগে বরফের পরিমাণ আরও কমে এসেছে। অর্থাৎ, মঙ্গল ধীরে ধীরে তার জলের ভাণ্ডার হারিয়ে ফেলেছে। বরফ গলে, হয়তো মহাকাশে উবে গেছে বা মাটির গভীরে প্রবেশ করেছে। ফলে আজকের মঙ্গল একেবারে শুষ্ক, অক্সিজেনহীন ও নির্জীব মনে হয়। পৃথিবীর মতো মঙ্গলও তার ঘূর্ণন অক্ষের কাত হওয়া বা ‘অব্লিকুইটি’ পরিবর্তন করে। কিন্তু মঙ্গলের ক্ষেত্রে এই দোলন অনেক বেশি তীব্র। কখনও তার অক্ষ এতটাই কাত হয়ে যায় যে, সূর্যের তাপ উত্তরের বদলে নিরক্ষরেখায় বেশি পড়ে। তখন বরফ গলে মেরু অঞ্চল থেকে নিম্ন অক্ষাংশে নেমে এসে গহ্বরগুলিতে জমা হয় এবং হাজার হাজার বছর টিকে থাকে। কিন্তু পরবর্তী যুগে যখন অক্ষ আবার সোজা হয়, তখন সেই বরফ ধীরে ধীরে উবে যায়। এই চক্র বারবার চলতে থাকায় মঙ্গলের বরফভান্ডার ক্রমে ক্ষীণ হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই গহ্বরগুলিতে লুকিয়ে থাকা বরফ ভবিষ্যতের মানব অভিযানের জন্য অমূল্য সম্পদ হতে পারে। মঙ্গলে মানুষ পাঠাতে হলে বিশাল পরিমাণে জল, অক্সিজেন ও জ্বালানি বহন করতে হবে। এটি মহাকাশযানের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু যদি স্থানীয়ভাবে বরফ থেকে জল আহরণ করা যায়, তা থেকে অক্সিজেন উৎপাদন ও এমনকি রকেট জ্বালানি তৈরিও সম্ভব। তাই মঙ্গলের যেসব অঞ্চল এখনো বরফ সংরক্ষণ করে রেখেছে সেগুলিই হতে পারে আগামী অভিযানের নিরাপদ ও সুকৌশল গন্তব্য। জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জাক্সা (JAXA)–এর বিজ্ঞানীরা বলেছেন, “এই বরফ-ঢাকা গহ্বরগুলো শুধু গ্রহের অতীত বোঝার জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতে মানব বসতি স্থাপনের দিকেও আমাদের পথ দেখাবে।” তবে এই আবিষ্কার শুধু মঙ্গল নয়, পৃথিবীর জলবায়ুবিজ্ঞান বোঝার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। মঙ্গলের মতো গ্রহে বরফ কীভাবে গঠিত হয়, সংরক্ষিত থাকে এবং ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়—এটি জানলে আমরা পৃথিবীর হিমবাহ, পার্মাফ্রস্ট ও জলবায়ু পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কেও নতুন ধারণা পেতে পারি।
গবেষক দলের এক সদস্যের ভাষায়,“মঙ্গল এক প্রাকৃতিক গবেষণাগার, যেখানে লক্ষ লক্ষ বছরের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণ এখনো স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এই তথ্য আমাদের পৃথিবীর ভবিষ্যৎ বুঝতেও সাহায্য করবে। মঙ্গলের বরফভান্ডার আমাদের জানায়, গ্রহটির ইতিহাস আসলে এক দীর্ঘ রূপান্তরের কাহিনী – যেখানে জীবন, জল ও বরফের উপস্থিতি ধীরে ধীরে বিলীন হয়েছে।
সূত্র : Long-term and multi-stage ice accumulation in the martian mid-latitudes during the Amazonian by Trishit Run et.el; September 02, 2025
