অদৃশ্য জলপ্রপাত

অদৃশ্য জলপ্রপাত

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৫ জুলাই, ২০২৫

নায়াগ্রা বা অ্যাঞ্জেল জলপ্রপাত যতই বিশ্বের বিখ্যাত ও সুদৃশ্যতম জলপ্রপাত হোক না কেন, পৃথিবীর বৃহত্তম জলপ্রপাত আসলে সবার চোখের আড়ালে, সমুদ্রের নীচে লুকিয়ে রয়েছে। এটি হলো ডেনমার্ক প্রণালীর জলপ্রপাত যার অবস্থান আইসল্যান্ড ও গ্রিনল্যান্ডের মধ্যবর্তী উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের নীচে। এই বিশাল জলপ্রপাতের কোনো গর্জন শোনা যায় না, নেই কোনো দৃশ্যমান ঝরনা। অথচ এটি প্রতি সেকেন্ডে ১২৩ মিলিয়ন ঘনফুট জল ঢালে, যা অ্যামাজনের প্রবাহকেও ছাড়িয়ে যায়।
পৃথিবীর অধিকাংশ বৃহৎ জলপ্রপাত গঠিত হয় যখন কোনো নদীর জল একটি ছোটো টিলার (cliff) মুখে পৌঁছে নীচে পড়ে যায়। প্রবল স্রোতের জলে পাথর ক্ষয় পেয়ে টিলার প্রান্ত আরও খাড়া হয়ে ওঠে। তখন এক মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি হয়, যেন পোস্টকার্ডে আঁকা সুন্দর দৃশ্য।
ডেনমার্ক প্রণালীর এই জল প্রপাতটি কিন্তু একটি ডুবো জলপ্রপাত। এই ধরনের জলধারার ধাঁচ একেবারে আলাদা। এখানে ঠান্ডা ও অধিক লবণাক্ত জল হালকা স্তরের নীচে ডুবে যায়, এবং সমুদ্রতল বরাবর এমনভাবে গড়িয়ে পড়ে, যেন কাত হয়ে রাখা পাত্রে সিরাপ গড়িয়ে পড়ছে। এই গতি নিঃশব্দ এবং এটি একটি নির্দিষ্ট স্রোত নয়, এ সম্পূর্ণ জলের স্তরকেই নীচে টেনে নিয়ে যায়।
সমুদ্রবিজ্ঞানীরা ডেনমার্ক প্রণালীর জলপ্রপাতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কয়েক দশক আগেই নিশ্চিত হন। প্রণালীর ভেতর দিয়ে তাপমাত্রা ও লবণাক্ততার রেখচিত্রের সন্ধান করেন।
সেন্সরগুলো দেখায় যে নর্ডিক সাগরের একটি ঘন জলীয় প্রবাহ আটলান্টিক বেসিনের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, এবং গতি পেতে পেতে একটি নিমজ্জিত টিলার পাশ দিয়ে নীচে পড়ে যাচ্ছে। সেই টিলাটি হচ্ছে সেই অদৃশ্য খাড়া প্রান্ত, যেখান থেকে শুরু হয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ জলপ্রপাতের পতন।
এই জলপ্রপাতটি প্রায় ১১,৫০০ ফুট গভীর, এবং প্রায় ৩০০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত। এই প্রবাহ ভূমিকা রাখে Atlantic Meridional Overturning Circulation (AMOC) প্রভৃতি বিশ্বব্যাপী মহাসাগরীয় সঞ্চালন ব্যবস্থায়, যা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ও পুষ্টি উপাদান ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই প্রক্রিয়ার উপরও পড়ছে। যেমন ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি এলাকায় উত্তরের ঠান্ডা বাতাসের প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় জলের প্রবাহ দুর্বল হচ্ছে, যার ফলে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ও জলবায়ুতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
এই লুকোনো জলপ্রপাত পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ঠান্ডা জলকে দক্ষিণে টেনে নিয়ে গিয়ে উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের জলকে উত্তরে প্রবাহিত হওয়ার জায়গা করে দেয়। এর মাধ্যমে শীতকালের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়, প্ল্যাংকটনের বৃদ্ধি হয়, এবং সামুদ্রিক প্রাণীরা পরিযানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পায়।

এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটি এখনও পুরোপুরি আবিষ্কৃত হয়নি। বিজ্ঞানীরা সাবমেরিন যন্ত্র, স্বয়ংক্রিয় গ্লাইডার ও উপগ্রহ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এর প্রবাহের গতি, ঋতুভিত্তিক পরিবর্তন ও ভবিষ্যৎ জলবায়ুর উপরে এর প্রভাব বুঝতে চেষ্টা করছেন। এই লুকোনো জলপ্রপাত চোখে দেখা না গেলেও, এর প্রভাব অনুভব করা যায় পৃথিবীর আবহাওয়া ও খাদ্য সরবরাহে।

সূত্রঃ earth.com website.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

6 + twelve =