অনন্য দশা ও কোয়ান্টাম গবেষণা

অনন্য দশা ও কোয়ান্টাম গবেষণা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৭ মে, ২০২৫

‘টেরা ইনকগনিটা’ কথাটির অর্থ ‘অজানা ভূখণ্ড’। শব্দবন্ধটি মধ্যযুগের মানচিত্রে সাহসী অভিযাত্রীদের সতর্ক সংকেত হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আজকের বিশ্ববীক্ষণে বিজ্ঞানীরা সেই অজানা ভূখণ্ডকেই খুঁজছেন – রহস্যময় কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে। আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে, যখন বিশাল ভর একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র অঞ্চলে সংকুচিত হয়, তখন একটি “ঘটনা দিগন্ত” তৈরি হয়। একটি সীমারেখা, যার বাইরে আলোসহ কোনো তথ্য আর ফিরে আসতে পারে না। এর গভীরে লুকিয়ে থাকে সিঙ্গুলারিটি বা অনন্য দশা। এ এমনই এক কেন্দ্র বা বিন্দু যেখানে মহাকর্ষ এতটাই প্রবল যে স্থান-কালের কোনো নিয়ম সেখানে খাটে না। ১৯৬০-এর দশকে, তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা দেখিয়েছিলেন, এই অনন্য দশা কেবল একটি গাণিতিক ভ্রম নয়। বরং এটি সার্বিক আপেক্ষিকতার নিজস্ব সীমাবদ্ধতার পরিচয়। ২০১৫ সালে LIGO-এর মাধ্যমে প্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তকরণ, এবং ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ দ্বারা M87\* ও Sagittarius A (ধনুরাশি)- র ছায়ার ছবি আমাদের নিশ্চিত করে যে কৃষ্ণগহ্বর কল্পনা নয়, খাঁটি বাস্তব। সম্প্রতি ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স অফ দ্য ইউনিভার্স একটি ব্যতিক্রমী কর্মশালায় বিভিন্ন ধারার তত্ত্ববিদ ও পর্যবেক্ষণবিদদের একত্রিত করে। এঁদের যুক্তি, বিতর্ক এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনটি প্রধান তত্ত্ব উঠে আসে। ক. ধ্রুপদী কৃষ্ণগহ্বর আইনস্টাইনের তত্ত্বের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত। এটি ঘটনাদিগন্ত এবং অনন্য দশার ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে। এটি সেই রহস্যময় কেন্দ্র, যেখানে পদার্থবিজ্ঞান অকেজো। খ. নিয়মিত কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে অসীমতা নেই। বরং কোয়ান্টাম প্রভাব অনন্য দশাকে একটি সসীম অঞ্চল দিয়ে প্রতিস্থাপন করে। গ. গ্রাভাস্টার, বোসন তারা বা ওয়ার্মহোল, প্রভৃতি অনুকরণকারী বস্তুর বাইরের চেহারা কৃষ্ণগহ্বরের মতো হলেও ভিতরের প্রকৃতি একেবারেই ভিন্ন। এদের রহস্যভেদের উপযুক্ত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এখনো আমাদের অনায়ত্ত। তবে উচ্চ-রেজোলিউশন চিত্র-প্রস্ফুটনের সাহায্যে অতিরিক্ত ফোটন বলয়, আলোর ভিন্নভাবে বেঁকে যাওয়া শনাক্ত করা যাবে, ভবিষ্যতের উন্নত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ডিটেক্টর দিয়ে আণবিক প্রতিধ্বনি শনাক্ত করা যাবে। এগুলি অনুকরণকারী বস্তু বা নিয়মিত কৃষ্ণগহ্বরের মতো কাঠামোগুলির কিছু সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দেয়। সিমুলেশন এবং গাণিতিক মডেলগুলি দ্রুত উন্নত হচ্ছে। সুপারকম্পিউটার ও নতুন নতুন অ্যালগরিদম তত্ত্বগুলোর বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। বিজ্ঞানীরা এখন এমন যন্ত্রের নকশা করছেন, যা ভবিষ্যতে এসব সূক্ষ্ম প্রভেদ ধরতে পারবে। অনন্য দশার ধারণা শুধুই এক গাণিতিক সমস্যা নয়। এটি কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণের অন্য এক দিগন্ত। যদি অনন্য দশার সূত্র সেখানে না খাটে, তাহলে ধরে নিতে হবে সেখানে এমন কিছু কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া কাজ করছে, যা আমাদের পদার্থ ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন ধ্যানধারণা দিতে পারে। IFPU-এর অন্যতম জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী, লিবেরাতি বলেন,” এ এক সন্ধিক্ষণ”। এই অনুসন্ধান শুধু কৃষ্ণগহ্বরের নয়, বরং স্থান, কাল এবং পদার্থবস্তুর প্রকৃতি নিয়ে আমাদের গভীরতম উপলব্ধির দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twenty + 1 =