অবাক পৃথিবী, সবুজ পৃথিবী

অবাক পৃথিবী, সবুজ পৃথিবী

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তারো মাতসুয়ো ও তাঁর গবেষক দল পৃথিবীর আদি জৈবমণ্ডল নিয়ে গবেষণা করেছেন। সেটি প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশল’ পত্রিকায়। তাঁরা জানাচ্ছেন, ২.৫ থেকে ৪ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর মহাসাগরগুলির রঙ ছিল সবুজ। এর মূলে ছিল সায়ানোব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়া। গবেষকদের দাবি, সায়ানোব্যাকটেরিয়ার সালোকসংশ্লেষণ ব্যবস্থাগুলির বিবর্তন সবুজ আলোর উপস্থিতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে এক মহাজাগতিক ধ্বংসাবশেষ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এই পৃথিবীর। আর তাতে প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল আজ থেকে ৩৭০ কোটি বছর আগে। প্রথম কোষটির আবির্ভাবের আগে মহাসাগরই পৃথিবীপৃষ্ঠকে ঢেকে রেখেছিল। সমুদ্রের তলদেশ থেকে জল-তাপীয় রন্ধ্রমুখগুলি থেকে বিস্ফোরণ ঘটে সমুদ্রকে ফেরাস আয়রন-ঘটিত জলে পূর্ণ করেছিল। এই রসায়নই সূর্যালোকের সাথে প্রাথমিক সমুদ্রের মিথস্ক্রিয়াকে সংজ্ঞায়িত করে। বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন এবং প্রচুর পরিমাণে লৌহ (Fe II) থাকায়, তখনকার মহাসাগরগুলির জল আজকের মতো নীল রঙকে প্রতিফলিত করতে পারত না। অপরদিকে অতিবেগুনি রশ্মি আটকানোর জন্য কোনো ওজোন স্তরের ঢালও ছিল না। না ছিল বায়ুমণ্ডলে পরিবর্তন আনার জন্য কোনো স্থল-উদ্ভিদ। পরিবর্তে, আলোর সাথে লোহা-সম্পৃক্ত ওই সমুদ্রগুলির যে-অদ্ভুত সম্পর্ক তা ওই সবুজ রঙের দিকে ঝুঁকে ছিল। সাইনোব্যাকটেরিয়ার আগমনের সাথে সাথে জলে অক্সিজেনের উপস্থিতি দেখা দিল। সেই অক্সিজেন ফেরাস লৌহকে রূপান্তরিত করল অদ্রাব্য ফেরিক লৌহে, যা মরচে জাতীয় কণা তৈরি করল। এই কণাগুলো ধীরে ধীরে থিতিয়ে পড়লেও মিলিয়ে গেল না। যেটুকু আলো সমুদ্রের গভীরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকল তাদের ওপর ক্রিয়া করল ওইসব কণা। জলে প্রলম্বিত ওই সূক্ষ্ম কণাগুলি আলোর ওপর শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করল। লাল এবং নীল তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে শোষণ করে নিল তারা, কিন্তু ছাড় দিল সবুজ আলোকে। ফলস্বরূপ, সমুদ্রগুলি নিজেই সবুজ রং ধারণ করল। সালোকসংশ্লেষের প্রাথমিক কর্তা সাইনোব্যাকটেরিয়া এবার এই সবুজ পরিবেশে অভিযোজিত হতে শুরু করল। সবুজ আলোর মধ্যে ক্লোরোফিল খুব একটা সুবিধে করতে পারল না। তাই বেঁচে থাকার জন্য সায়ানোব্যাকটেরিয়া তখন ফাইকোবিলিসোম নামক এক পদার্থ তৈরি করল। এগুলির মস্ত মস্ত শুঁড়গুলো ঠাসা থাকত আনুষঙ্গিক রঙ্গক পদার্থে। এই রঙ্গকগুলির মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল ফাইকোইরিথ্রোবিলিন। এটি সবুজ আলো শোষণ করে নিয়ে সেই শক্তি পাঠিয়ে দেয় ক্লোরোফিলে, যাতে সালোকসংশ্লেষ ঘটতে পারে। প্রধান গবেষক মাতসুও বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি এই অভিযোজনের সুবাদেই তারা ওই লোহা-সমৃদ্ধ সবুজ সমুদ্রে বেঁচেবর্তে থাকতে পেরেছিল’।
এই ধারণাটির সত্যতা যাচাই করবার মাতসুও ও তার সহকর্মীরা আর্কিয়ান ভূতত্ত্বিক যুগের সময়কার জলের নিচের আলোক পরিবেশ পুনর্নির্মাণের জন্য সংখ্যাভিত্তিক সিমুলেশন করে দেখেন। দেখা গেল, পাঁচ থেকে কুড়ি মিটার গভীরতায় আয়রন হাইড্রোক্সাইড কণাগুলি একটি লাগাতার সবুজ আলোর জানালা তৈরি করে। এই পরিস্থিতিতে সবুজ আলোর প্রাধান্য ফাইকোইরিথ্রোবিলিন (পিইবি) শোষণ পাল্লার সাথে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায়। ফলে বিবর্তনের দিক থেকে তারা একটা সুবিধে পেয়ে গেল। এছাড়াও গবেষকরা পিইবি তৈরির জন্য সুকৌশলে ব্যাকটেরিয়ার বিশেষ প্রজাতি তৈরি করেন। দেখা গেল তৈরি-করা এই প্রজাতিগুলি সবুজ আলোর পরিবেশে বুনো প্রজাতিগুলির তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে বংশবৃদ্ধি করল।
এর পর তাঁরা ২০২৩ সালে জাপানের সাতসুনান দ্বীপপুঞ্জের আইও দ্বীপে গিয়ে আদিম প্রাকৃতিক পরিবেশে তাঁদের প্রতিপাদ্যর অকাট্য প্রমাণ পেলেন।
এই গবেষণা থেকে আদি পৃথিবীর এক ভিন্ন ধরণের চিত্র ফুটে উঠেছে। সে চিত্রটি একটি হালকা সবুজ গোলকের, যেখান থেকে অপ্রত্যাশিত নানান পথে গড়ে উঠেছিল প্রাণ।

সূত্র: https://www.earth.com/news/earth-was-once-a-green-marble-before-its-oceans-turned-blue/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve + 6 =