অস্ট্রিয়ায় সুসংরক্ষিত মমি

অস্ট্রিয়ায় সুসংরক্ষিত মমি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ মে, ২০২৫

মমি শুনলেই মিশরের কথা মনে পড়ে। কিন্তু অস্ট্রিয়ার সেন্ট থমাস অ্যাম ব্লাসেনস্টাইনের গির্জায় আবিষ্কৃত মমিটি দেখিয়ে দিল, ইউরোপও জানত কিভাবে মৃতদেহের পচন ঠেকিয়ে রাখতে হয়। গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন এক বহুশতাব্দী প্রাচীন দেহ, যা অস্বাভাবিকভাবে সংরক্ষিত। মৃত, অথচ যেন অমর! যেন এক ‘টাইম ক্যাপসুল’। মমিটি কোনো রাজা, ফেরাউন বা রাজবংশের কারুর নয়, এক সাধারণ ছোটো আংচলিক গির্জার পুরোহিতের, নাম ফ্রাঞ্জ জাভার সিডলার ভন রোজেনেগ। এখানে কোনও যাদু নেই। তবে এত সুন্দর ভাবে সংরক্ষণের রহস্য কোথায়? তাকে ঘিরেই উঠে এসেছে এক অজানা, পরীক্ষাভিত্তিক বিজ্ঞান। উপকরণ হল কাঠের টুকরো, শুষ্ক ডালপালা, পুরোনো কাপড় আর মূল উপাদান জিঙ্ক ক্লোরাইড। এই রসায়নের মধ্যেই লুকিয়ে অমরত্বের সূত্র। জার্মানির লুডভিগ-ম্যাক্সিমিলিয়ান্স ইউনিভার্সিটির প্যাথলজিস্ট ডাক্তার আন্দ্রেয়াস নেরলিচ জানান, “এটি ছিল ‘আন্ত্রিক প্রলেপ’ এর মতো কিছু। উপকরণগুলি ঢোকানো হয়েছিল মলদ্বার পথে। তার জন্য শরীর খোলা বা চেরা হয়নি। একরকম গোপনীয়তা বজায় রেখেই, শরীরটিকে বদলে ফেলা হয়েছিল এক সংরক্ষিত কাঠামোয়”। সিটি স্ক্যান, ময়না তদন্ত আর রেডিওকার্বন ডেটিংয়ে উঠে এসেছে, লোকটির উপরের শরীর ছিল অক্ষত, অথচ নিচের অংশে ক্ষয় ধরেছে। পেটের ভেতর খুঁজে পাওয়া গেছে দেবদারু গাছের গুঁড়ি, শাখা, শণ, পাটের কাপড়, এমনকি এক রহস্যময় কাচের পুতিও! সম্ভবত এটি কোনও সন্ন্যাসীর পোশাকের অংশ। মমিটি সিডলারের বলে দীর্ঘদিন ধরে গুজব ছিল, কিন্তু এই গুজবের উৎস অজানা। তবে, কেবলমাত্র বর্তমান তদন্তই এর পরিচয় নিশ্চিত করেছে। এই বিশ্লেষণগুলি দেখিয়েছে যে মমিটি সম্ভবত ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সে এবং সম্ভবত ১৭৩৪ থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে মৃত ব্যক্তির। এই তারিখগুলি সিডলারের জীবনের সাথে মিলে যায়। ভিতরে থাকা খাদ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মৃত ব্যক্তির খাদ্য তালিকায় ছিল উচ্চ মানের মধ্য-ইউরোপীয় শস্য, মাংস এবং নদীর মাছ। জীবনের শেষদিকে খাদ্যাভাবের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্ভবত এটি অস্ট্রিয়ান সিংহাসন দখল যুদ্ধের সময়ের প্রতিফলন। আর ছিল দীর্ঘদিনের ধূমপান আর শেষদিকে যক্ষ্মার ছাপ। মৃত শরীরেও অভ্যাসের ছাপগুলি রয়ে যায়। আরও অবাক করা তথ্য হল, কঙ্কালের উপর কোনো ভারি পরিশ্রমের চিহ্ন নেই। পুরোহিতের জীবন যে সাধারণত শ্রম-মুক্ত হয়, সেটিও যেন মিলে যাচ্ছে। প্রমাণ বলছে, এই মমি প্রস্তুত করা হয়েছিল অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য, হয়তো তার নিজস্ব মঠে ! কিন্তু সেই ভ্রমণ শেষ পর্যন্ত ঘটেনি। এই মমিটি শুধু ইতিহাস নয়, এক জীবনচক্রের ছায়াচিত্র- যেখানে ধর্ম, বিজ্ঞান আর মৃত্যু একসাথে বুনেছে এক অনন্য সংরক্ষণের রহস্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × 2 =