পৃথিবীতে বিভিন্ন কালে একজন মানুষ অন্য মানুষের মঙ্গলসাধনের অভিপ্রায়ে যুগান্তকারী কিছু করতে উদ্যোগী হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তা অনুকূল হয়েছে। কিন্তু কখনো কখনো পদ্ধতিগত কিছু ভুলে, সেই প্রচেষ্টা বিপরীতমুখী হয়ে অমঙ্গলে পরিণত হয়েছে। উপরন্তু নিজেদের সুবিশাল আত্মাভিমানের চাপে, চোখের সামনে বারংবার সেই ভুল হতে দেখেও, তাঁরা বিরত থাকেননি। ফলে, এক সময় মানবসমাজে ঘোর বিপদ নেমে এসেছে। এরকমই একজন ‘ডাক্তার’-এর কুখ্যাত অথচ প্রচলিত কার্যাবলি নিয়ে ‘বিজ্ঞানভাষ’-এর আজকের নিবন্ধ লিখছি।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জন.এফ.কেনেডির ছোট বোন ছিলেন রোসমেরি কেনেডি। সাধারণের ভাষায় তিনি একটু ‘অন্যরকম’ ছিলেন। হাসিখুশি, চনমনে মেয়েটির মানসিক বিকাশ একটু বিলম্বিত ছিল। ফলে যা হয়। অতবড় রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য একটু ‘আলাদা’ হলে, তা ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলতে পারে। এই ভয়ে জোসেফ কেনেডি তাঁর মেয়ে রোসমেরির চিকিৎসা করানো সাব্যস্ত করেন। যোগাযোগ করা হয় ডক্টর ওয়াল্টার ফ্রীম্যান-এর সাথে।
কে এই ওয়াল্টার ফ্রীম্যান?
একটু ফোকাস ঘোরাই এবার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০-এর দশকে আমেরিকার মানসিক হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা তখন উপচে পড়ছে। সেই সময়ে না ছিল ওষুধ, না ছিল উপযুক্ত চিকিৎসা। মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা তখন হামাগুড়ি দিচ্ছে। কোন জটিল রোগে সর্বোচ্চ যেটা করা হত, তা হল মাথার দু’পাশে ছিদ্র তৈরী করে, সেখান দিয়ে সূক্ষ্ম একটি ধাতব বস্তু প্রবেশ করিয়ে ‘ফ্রন্টাল লোব’ এবং ‘থ্যালামাস’-এর সংযোগ কেটে ফেলা।
ফ্রন্টাল লোব আর থ্যালামাস কী তা বলে নিই।
এক লাইনে বলতে গেলে, কপালের পিছনেই মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব অবস্থিত, যা মানুষের চিন্তা, যুক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। থ্যালামাস এর নিচেই অবস্থিত এবং তাকে মানুষের সুখ-দুঃখের কন্ট্রোল প্যানেল বলা যেতে পারে।
মানসিক হাসপাতালে যখন ওইভাবে দীর্ঘায়িত অস্ত্রোপচার হচ্ছে, সেই সময় আবির্ভাব হয় নিউরোলজিস্ট ওয়াল্টার ফ্রীম্যান-এর। হাসপাতালগুলোকে রোগীমুক্ত করার সৎ-চিন্তায় তিনি এক অত্যন্ত দ্রুত চিকিৎসার শরণাপন্ন হন, যার প্রবর্তন অবশ্য আগেই হয়েছিল। এর নাম ‘লোবোটমি’ (lobotomy)। এই শল্য-চিকিৎসার আয়োজনও অল্প। একটা সামান্য আইস-পিক (ice-pick) দিয়েই করা যায়, যা কিনা যে কারোর রান্নাঘরেই উপলব্ধ।
ফ্রীম্যান তাঁর কর্মকাণ্ড শুরু করলেন। মানুষের কপালের হাড় ভিতরের দিকে ঢুকে এসে চোখের কোটর বা অর্বিট-এর সৃষ্টি করে। সেখানে হাড় খুব নরম। রোগীর চোখের পাতার নিচ দিয়ে আইস-পিক ঢুকিয়ে, ফ্রীম্যান সেই জায়গার মধ্য দিয়ে ট্রান্স-অর্বাইটাল (trans-orbital) প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কে পৌঁছোতে সচেষ্ট হন। তারপর সূঁচের একটা সামান্য মোচড়ে ফ্রন্ট্রাল-লোব আর থ্যালামাসকে বিচ্ছিন্ন করে রোগীর রোগ ‘নিরাময়’ করার প্রয়াস করেন।
এইভাবে ১৯৫০ অবধি ফ্রীম্যান প্রায় দু’হাজার লোবোটমি করেছেন সর্বসমক্ষে। কিন্তু রোগীরা কী সত্যিই সুস্থ হয়েছিল? কেউ কেউ হয়ত হয়েছিল। কিন্তু অনেকেরই হয়নি। তাদের কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে একটি জড়পদার্থে পরিণত হয়। কারোর মধ্যে ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন আসে। এক রোগীর ক্ষেত্রে আইস-পিক মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম ধমনীকে ছিন্ন করে তার মৃত্যু ঘটায়। অনেক সময়, একজন রোগী আগামী দিনে পাছে আরো বেশী অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেই ‘সম্ভাবনায়’ ফ্রীম্যান অস্ত্রোপচার করেছেন অল্পবয়সীদের উপরেও। বলা বাহুল্য ওই বয়সে একজন মানুষের মস্তিষ্কই পরিপূর্ণভাবে গঠিত হয় না।
ফ্রীম্যান-এর এই অদূরদর্শী হঠকারিতার জন্য তাঁকে সাজা পেতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু বহু হাসপাতাল তাঁর এই ভয়ঙ্কর পদ্ধতিকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে দিতে থাকে। চিকিৎসা-ইতিহাসে ‘লোবোটমি’ থেকে যায় একটি অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে।
মানুষের আপাত-মঙ্গলকর, অবিমৃশ্যকারী পদক্ষেপ যে কতটা হানিকর হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডির প্রাণোচ্ছল বোন রোসমেরি।
ছবি সৌজন্যঃ কুকসইনফো