আচমকা কোষ সাফাই

আচমকা কোষ সাফাই

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শরীর আঘাত পেলে প্রথমেই সক্রিয় হয়ে ওঠে আমাদের কোষ। তারা ক্ষত পরিষ্কার করে, ভাঙা অংশ জোড়া লাগায়, এমনকি প্রয়োজনে একেবারে ‘রিসেট’ মোডে চলে যায়। দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা জানেন, এই কাজের জন্য কোষ কখনও আত্মবিনাশ করে আবার কখনো একধরনের ‘স্টেম সেল’-এর মতো অবস্থায় ফিরে গিয়ে নতুন করে কোষকলা গড়ে তোলে। কিন্তু এবার একদল গবেষক চিহ্নিত করেছেন এক অপ্রত্যাশিত শর্টকাট, যা কোষকে দ্রুত ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। নাম দেওয়া হয়েছে ক্যাথার্টোসাইটোসিস (Cathartocytosis), অর্থাৎ হঠাৎ করে কোষের ‘বর্জ্য বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়া’। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন (সেন্ট লুইস) এবং বেইলর কলেজ অব মেডিসিন-এর গবেষকরা দেখেছেন, বিশেষ করে পেটের আস্তরণে আঘাত পেলে কোষগুলো স্বাভাবিক নিয়মে ধীরে ধীরে লাইসোসোম ব্যবহার করে ভেতরের পুরোনো যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিচ্ছে না। বরং একচোটে হঠাৎ করেই পুরো ভেতরের আবর্জনা কোষের বাইরে ছুড়ে ফেলছে। প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, কোষের বাইরে জমে থাকা এসব বর্জ্য আশেপাশের পরিবেশ থেকেই এসেছে। পরে দেখা গেল, এগুলো আসলে কোষ নিজেই ফেলেছে। একই সময়ে তারা স্টেম সেল সদৃশ অবস্থায় ফিরে গিয়ে মেরামতির কাজ শুরু করছে। গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী ড. জেসন সি. মিলস বলেন, “এই প্যালিজেনোসিস(paleogenosis) অর্থাৎ ক্ষত সারাতে কোষের স্টেম সেল অবস্থায় ফিরে যাওয়া, প্রকৃতপক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে এখন যখন আমরা জানলাম যে এর মধ্যে এই হঠাৎ বর্জ্য নির্গমনও ঘটছে।” প্রধান গবেষক ড. জেফ্রি ডব্লিউ. ব্রাউন ব্যাখ্যা করেন, “আঘাতের পর কোষের প্রধান কাজ ক্ষত সারানো। কিন্তু পরিপক্ব কোষের স্বাভাবিক যন্ত্রপাতি সেই কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই ক্যাথার্টোসাইটোসিস হলো দ্রুত সাফাইয়ের কৌশল। সব জটিল যন্ত্রপাতি সরিয়ে ফেলে কোষকে ছোট, সহজ, এবং ক্ষত সারানোর উপযোগী অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া।” অর্থাৎ এই প্রক্রিয়া কোষকে দ্রুত পুনর্গঠনের ক্ষমতা দেয়। তবে এই তাড়াহুড়োর খেসারতও আছে। কোষ থেকে বেরিয়ে আসা বর্জ্য হাওয়ায় মিলিয়ে যায় না। সেগুলো বাইরে জমে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। আর যদি একই জায়গায় বারবার আঘাত লাগে, তবে প্রদাহ দীর্ঘস্থায়ী হয়, যার সঙ্গে ক্যানসারের ঝুঁকি জড়িত।
ড. মিলস সতর্ক করে বলেন, “যদি পুরোনো, পরিব্যক্ত কোষগুলো স্টেম সেল অবস্থায় ফিরে গিয়ে বিভাজন শুরু করে, এবং সেই সঙ্গে প্রদাহও সক্রিয় থাকে, তাহলে ক্ষতিকর মিউটেশন ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। এভাবেই ক্যানসারের বীজ বোনা হতে পারে।” আশার কথা, গবেষক দল ইতিমধ্যেই এক বিশেষ অ্যান্টিবডি তৈরি করেছেন যা কোষ থেকে বেরিয়ে আসা এই বর্জ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এর মাধ্যমে বোঝা যাবে কোথায় কতটা ক্যাথার্টোসাইটোসিস ঘটছে—সম্ভবত ক্যানসার তৈরি হওয়ার আগেই। ড. ব্রাউন বলেন, “যদি আমরা এই প্রক্রিয়াকে ভালোভাবে বুঝতে পারি, তবে একদিকে ক্ষত সারানোর প্রতিক্রিয়া বাড়ানো সম্ভব হবে, অন্যদিকে দীর্ঘস্থায়ী আঘাতের ক্ষেত্রে ক্যানসার প্রতিরোধও করা যাবে।”এখনও পর্যন্ত গবেষণা হয়েছে ইঁদুরের পাকস্থলীতে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, শরীরের অন্য অঙ্গেও এই প্রক্রিয়া ঘটতে পারে। বিশেষত হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরাই সংক্রমণ, যা পাকস্থলীর আলসার এবং ক্যানসারের সঙ্গে যুক্ত, সেক্ষত্রে ক্যাথার্টোসাইটোসিস বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। আপাতত বিজ্ঞানীরা বলছেন, ক্যাথার্টোসাইটোসিস হলো কোষের ক্ষত সারানোর এক নতুন দিক। এটি দ্রুত কিন্তু অগোছালো, একই সঙ্গে নায়ক ও খলনায়ক। একদিকে ক্ষত সারায়, অন্যদিকে দীর্ঘস্থায়ী ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ভবিষ্যতের চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই “হঠাৎ কোষ-সাফাই ” প্রক্রিয়াই হয়তো হয়ে উঠবে ক্যানসার প্রতিরোধের নতুন কৌশল।

সূত্র : Cathartocytosis: Jettisoning of cellular material during reprogramming of differentiated cells by Jeffrey W. Brown, et.al ; Cell Report (Volume 44 ; Issue 8) (August 26 , 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 + twenty =