আদি মানুষের নেকড়ে পোষা

আদি মানুষের নেকড়ে পোষা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৩ আগষ্ট, ২০২৫

পুরাকালে নেকড়েরা মানুষের পাশে পাশে ঘুরে বেড়াত। ধীরে ধীরে সে মানুষের ‘পোষ্য’ হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন প্রমাণ মিলছে, নেকড়ে নিজে থেকে মানুষের ডেরায় ঢুকত না বরং মানুষই নেকড়ে ছানা ধরে এনে নিজ হাতে বড় করত। হিউম্যান ইনিশিয়েটেড মডেল এই কথা বলছে। এই মডেলে মানুষের তৈরি নির্দেশনার ভিত্তিতে একটি সিস্টেম কাজ করে। প্রাগৈতিহাসিক শিকারি-সংগ্রাহকরা নিয়মিত বনের গুহা বা গর্ত থেকে দু’সপ্তাহের কম বয়সী, চোখ না-ফোটা ছানা নিয়ে আসত। নিজেদের শিবিরে ছানাদের রেখে খাওয়াত, তাদের সাথে খেলত, তাদের এক প্রকার সামাজিক করে তুলত। আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এভাবেই মানুষের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতো এই প্রাণীরা। অস্ট্রেলিয়ান রিসার্চ সেন্টার ফর হিউম্যান ইভোলিউশন, রয়্যাল বেলজিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ন্যাচারাল সায়েন্সেস, ইউনিভার্সিটি অব সিডনি ও এএনইউ-র যৌথ গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, পরবর্তী প্লাইস্টোসিন যুগের ইউরেশিয়ান যাযাবররা প্রায়ই এভাবে নেকড়ে ছানা দত্তক নিত। আজও দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় ৭০% কুকুর মানুষদের থেকে সাধারণত স্বাধীনভাবে থাকে। তাই ‘ঘরের পোষা’ কুকুর একেবারে আধুনিক ব্যাপার। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বিষয়টা ঠিক ততটা আধুনিক নয়। কৃষি শুরু হওয়ার বহু আগেই মানুষ ও ক্যানিডের (নেকড়ে-জাতীয় প্রাণী) মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়েছিল। বেলজিয়ামের গোয়েতে গুহা থেকে পাওয়া একটি খুলি (৩৬,০০০–৩১,৭০০ বছর পুরোনো) ছিল নেকড়ের মতো। কিন্তু পুরোপুরি নেকড়েও নয়-বরং এটিকে যেন ‘আদি পর্যয়ের কুকুর’ বলা চলে। সাইবেরিয়ার রাজবোইনিচ্যা গুহা থেকেও ৩৩,০০০ বছরের পুরোনো একই রকম একটি খুলির সঙ্গে প্রাচীন ডিএনএ প্রমাণ মিলেছে। সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণটি অবশ্য জার্মানির বন-ওবারক্যাসেল সমাধি। সেখানে প্রায় ১৪,২০০ বছর আগে একজন মানুষ ও একটি কুকুর একসঙ্গে সমাধিস্থ হয়েছিল। কিন্তু তার আগেও ‘আধা-কুকুর’রা মানুষের পাশে বাস করত। নেকড়েদের জন্ম হয় অন্ধ অবস্থায়। প্রায় দুই সপ্তাহ পরে তাদের চোখ ফোটে। এই সময়টাতে মানুষের হাতের যত্ন তাদের স্বভাব বদলে দিতে পারে। আজও দেখা গেছে, হাতে বড় করা নেকড়ে মানুষের সাথে গভীর বন্ধন গড়ে তুলতে পারে। আর এমন গুণই প্রাচীন শিকারিদের ছানা পালনে সাহায্য করত। এটা কিন্তু পুরোনো স্ব-গৃহপালন কাহিনীর বিপরীত। ‘স্ব-গৃহপালন’ একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা যা মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ ধরনের বিবর্তনের প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করে। যেখানে মানুষ নিজের কিছু বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে, যা সাধারণত গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়। আর এক্ষেত্রে, আবর্জনার স্তূপে ঘুরতে ঘুরতে নেকড়ে নিজে গৃহপালিত হয়নি, বরং মানুষই সক্রিয়ভাবে তাদের যত্ন, বাছাই ও বংশবিস্তার করিয়েছে। চেক প্রজাতন্ত্রের প্রেদমোস্তি সাইটে দাঁত ও হাড়ের রাসায়নিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা গেছে, ‘কুকুর-জাতীয়’ ক্যানিডরা বেশি বল্গা হরিণ ও কস্তুরী বৃষ খেত। আর নেকড়েরা বেশি ম্যামথ খেত। দাঁতের ক্ষয়-প্যাটার্নও ছিল আলাদা। মানে, খাবারের ভূমিকা আলাদা ছিল। অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীরা আজও একইরকমভাবে ডিঙ্গো ছানা ধরে আনে, শিবিরে বড় করে, আর বড় হলে অনেককে ছেড়ে দেয়। এই চক্র বহু প্রজন্ম ধরে আশেপাশের বুনো ক্যানিডের জিনে প্রভাব ফেলতে পারে। এভাবে, অনেক ছানাই বনে ফিরে যেত। তবু মানুষ প্রতি মৌসুমে নতুন ছানা আনত। শান্ত, বন্ধুসুলভ প্রাণীই বাছাই হতো বারবার। প্রাগৈতিহাসিক খুলির বয়স, হাড়ের রসায়ন, দাঁতের ক্ষয় এবং আধুনিক শিকারি সমাজের উদাহরণ, এ সব একই দিকে ইঙ্গিত করছে- মানুষ অপেক্ষা করেনি নেকড়ে আসার জন্য, বরং বসন্তকাল এলেই নিজেরাই বেরিয়ে পড়ে বেছে নিত ভবিষ্যতের সঙ্গী।

সূত্র : The human-initiated model of wolf domestication – An expansion based on human-dingo relations in Aboriginal Australia by
Adam Brumm, et.al ; Frontiers in Psychology(June, 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 − fifteen =