
একটি নতুন গবেষণা বিশ্বব্যাপী স্বাদুজলে অক্সিজেন চক্রের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের কথা প্রকাশ করেছে। নদী ,জলপ্রপাত, হ্রদ এবং জলাধারগুলি তো শুধুমাত্র ভূবৈচিত্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, এগুলি পৃথিবীতে জীব্কুলের প্রাণধারণের জন্যও অত্যাবশ্যকীয় । এই আন্তর্দেশীয় জলাশয়গুলির কার্যকারিতা বজায় রাখার জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। কিন্তু ইউট্রেক্ট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে নতুন অনুসন্ধান অনুসারে জানা যাচ্ছে যে গত শতাব্দীতে মানবযুগে আমরা ধীরে ধীরে এদের নিঃশেষের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছি। ‘সায়েন্স আডভান্সেস ’ -এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, যে প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন স্বাদুজল বন্টন প্রণালীতে তৈরী হয় ও ব্যবহৃত হয় , মানুষের কার্যকলাপের ফলে উনিশ শতক থেকে সেটির খুব আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে ।
অক্সিজেন শুধুমাত্র জলজ জীবের ক্ষেত্রেই অত্যাবশ্যকীয় উপাদান নয়, এটি কার্বন ও নাইট্রোজেন চক্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি চক্রেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। যখন অক্সিজেনের মাত্রা কমতে শুরু করে, যাকে হাইপক্সিয়া বলে, তখন বাস্তুতন্ত্রে আঘাত লাগে। মাছ মারা যায়, খাদ্যজাল ভেঙে যায়, জলের গুণমান কমতে শুরু করে। এর প্রভাব ইতিমধ্যেই বৈশ্বিকভাবে অনুভূত । এই গবেষণা থেকে এটি পরিষ্কার যে যা হয়ে চলেছে তা কোনো স্থানীয় সমস্যা নয়। আমরা বৈশ্বিক ও মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যার মধ্যে দিয়ে চলেছি।
ইউট্রেক্ট ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানী জুঞ্জি ওয়াং এবং জ্যাক মিডেলবার্গের তত্ত্বাবধানে একদল বিজ্ঞানী একটি বৈশ্বিক মডেল তৈরী করেছেন যা সারা বিশ্বব্যাপী আন্তর্দেশীয় জলাশয়ের সম্পূর্ণ অক্সিজেন চক্রকে বর্ণনা করে। জ্যাক মিডেলবার্গ ব্যাখ্যা করেন, “ আমরা এই মডেলটির মাধ্যমে, বৃহত্তর পরিসরে সম্পূর্ণ, সম্ভাব্য, বোধগম্য একটা ধারণা দিই , যার ফলে অক্সিজেন সম্পর্কিত সমস্যাগুলি দেখা ও তার কারণ জানা এবং সময়মতো হস্তক্ষেপ করা যায়।”
অক্সিজেনের ক্ষেত্রে আন্তর্দেশীয় জলাশয়গুলি এখন খুবই চর্চিত । দলটি দেখেছে বিশ্বব্যাপী “অক্সিজেন টার্নওভার” যে পরিমাণে উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হয় তা বৃদ্ধি পেয়েছে । কিন্তু এখানেই চমক: এই জলাশয়গুলি যা অক্সিজেন উৎপাদন করে তার তুলনায় অনেক বেশি অধিগ্রহণ করে , যা তাদের বায়ুমণ্ডলীয় অক্সিজেন আধারে পরিণত করেছে ।
জুঞ্জি ওয়াং বলেন, “অধিক চাষাবাদ , অধিক জল অপচয় , অধিক বাঁধ এবং উত্তপ্ত জলবায়ু – এগুলি সবই স্বাদুজলের বাস্তুতন্ত্রের ওপর ক্রিয়া করে তার পরিবর্তন ঘটায়”। নদী, হ্রদ এবং জলাশয়ে প্রবাহিত অধিকতর পুষ্টির সাথে শ্যাওলাও দ্রত বৃদ্ধি পায়, কিন্তু যখন মারা যায় বা পচে যায় তখন তারা প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন ব্যবহার করে। “ আমরা দেখেছি যে এর প্রধান কারণগুলি মনুষ্যসৃষ্ট ক্রিয়াকলাপের মধ্যে নিহিত। প্রথমত, এটি বেরিয়ে আসে পুষ্টি ইনপুটের মাধ্যমে। যেমন অতিরিক্ত উর্বরতা বৃদ্ধি এই ত্বরণের প্রধান চালক। দ্বিতীয়ত , বাঁধ ও জলাশয় নির্মাণের সময় সমুদ্রে স্বাদুজলের দীর্ঘসময়ব্যাপী বিচরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত,” বলেন জ্যাক মিডেলবার্গ।
একই সাথে ,তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো পরোক্ষ মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলি জলে অক্সিজেনকে স্বল্পদ্রবণীয় করে তোলে , জলস্তরকে উল্লম্বভাবে ধীরগতিতে প্রবাহিত করে এবং এর মধ্যে দিয়ে দ্রুত প্রক্রিয়াগুলিকে দ্রুততর করে। “ এখনো পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক লেখাপত্রে সর্বসম্মত মত ছিল যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রাথমিক কারণ এই ত্বরণ । কিন্তু আমাদের মডেলটি দেখাচ্ছে যে উষ্ণায়ন এই ঘটনার প্রায় ১০-২০% অবদান রাখে”- বলেন জুঞ্জি ওয়াং।
এই গবেষণায় দেখা গেছে যে আন্তর্দেশীয় জলে আধুনিক অক্সিজেন চক্রটি উনিশ শতকের প্রথম দিকের মতো কিছুই দেখায় না। “ যদিও এই জলাশয়গুলি পৃথিবীপৃষ্ঠের একটি ক্ষুদ্র অংশকে আবৃত করে, তারা প্রতি বছর বায়ুমণ্ডল থেকে ১ বিলিয়ন টন অক্সিজেন অপসারণ করে। এ পরিমাণ সমগ্র মহাসাগর যা নির্গত করে তার ঠিক অর্ধেক।“ বলেন মিডেলবার্গ।
“ বৈশ্বিক জলবায়ু এবং অক্সিজেন বাজেটে অন্তর্দেশীয় জলাশয়কে আর উপেক্ষা করা চলে না,’ যোগ করেন জুঙ্গি ওয়াং। “ আমরা যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও দ্রুত মাত্রায় এরা পরিবর্তিত হচ্ছে , এরা পৃথিবীর বিমূঢ় অবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ “।