আফ্রিকায় পার্মিয়ান যুগের জীবের সন্ধান

আফ্রিকায় পার্মিয়ান যুগের জীবের সন্ধান

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
Default Alt Text

প্রায় পনেরো বছর ধরে আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করছেন জীবাশ্মবিদদের এক আন্তর্জাতিক দল । তাঁদের লক্ষ্য, ২৯৯ থেকে ২৫২ মিলিয়ন বছর পর্যন্ত বিস্তৃত পার্মিয়ান যুগের জীববৈচিত্র্যকে বোঝা। এই ভূতাত্ত্বিক যুগের শেষেই ঘটেছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী ‘মহাবিলুপ্তি’, যা ‘ব্যাপক মৃত্যু’ নামে পরিচিত। এতে বিলীন হয়ে যায় প্রায় ৭০ শতাংশ স্থলজ প্রাণী এবং তারও বেশি সমুদ্রজ জীব। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিকাগোর ফিল্ড মিউজিয়ামের নেতৃত্বে, গবেষকরা দক্ষিণ পানজিয়ার (তৎকালীন মহাদেশীয় অতি মহাদেশ) জীবদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন- যারা এই বিলুপ্তির ঠিক আগে পৃথিবীতে বিচরণ করত। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্রিশ্চিয়ান সিডর বলেন,“এই মহাবিলুপ্তি ছিল পৃথিবীর জীবনে এক বিপর্যয়কর ঘটনা, যা বিবর্তনের গতিপথই বদলে দিয়েছিল। কিন্তু আমরা এখনও পুরোপুরি জানি না কোন প্রজাতি টিকে ছিল, কোনটি হারিয়ে গিয়েছিল আর কেন। তানজানিয়া ও জাম্বিয়ায় সংগৃহীত জীবাশ্ম আমাদের বিশ্বজোড়া পরিপ্রেক্ষিত থেকে ওই সময়কে বোঝার সুযোগ দিচ্ছে।” সম্প্রতি প্রকাশিত ১৪টি প্রবন্ধে এই গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে পার্মিয়ান আফ্রিকার বিচিত্র প্রাণীকুলের ছবি। দাঁতাল শিকারি, সুড়ঙ্গ খননকারী তৃণভোজী, এমনকি সালামান্ডারের মতো বিশাল উভচর প্রাণী। এই জীবাশ্মগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে আফ্রিকার তিনটি বেসিন থেকে। রুহুহু বেসিন (দক্ষিণ তানজানিয়া), লুয়াঙ্গওয়া বেসিন (পূর্ব জাম্বিয়া), মধ্য-জাম্বেজি বেসিন (দক্ষিণ জাম্বিয়া)। সাম্প্রতিক খননে কিছু জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। আবার কিছু দশক আগে সংগৃহীত হয়েছিল আরো বেশ কিছু। এগুলিকে সংগ্রহশালার ভান্ডারে সযত্নে সংরক্ষিত করে রাখা হয়। ২০০৭ সাল থেকে গবেষক দলটি বারবার এই অঞ্চলে গিয়েছে। পাঁচবার রুহুহুতে, চারবার লুয়াঙ্গওয়া ও মধ্য-জাম্বেজি বেসিনে। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গবেষকরা। আফ্রিকার গ্রাম বা উন্মুক্ত প্রান্তরে তাঁবু খাটিয়ে তাঁরা কাজ করেন। বিশ্লেষণ শেষে সব জীবাশ্ম তানজানিয়া ও জাম্বিয়ার সরকারকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

পার্মিয়ান যুগ ছিল প্যালিওজোয়িক যুগের শেষ অধ্যায়। এ সময়েই প্রাণীরা সমুদ্র থেকে স্থলে পা রাখে এবং জটিল স্থলভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে। উভচর ও সরীসৃপসদৃশ প্রাণীরা বন থেকে শুরু করে শুষ্ক উপত্যকা পর্যন্ত বিচরণ করত। কিন্তু যুগের শেষে ঘটে বিধ্বংসী মহাবিলুপ্তি। যার কারণ নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। এর জন্য আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা সমুদ্রের অক্সিজেন হ্রাস প্রভৃতি নানা ব্যাখ্যা রয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের পর শুরু হয় মেসোজোয়িক যুগ, যেখানে আবির্ভূত হয় ডাইনোসর, প্রথম পাখি, সপুষ্পক উদ্ভিদ ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ আফ্রিকার কারু বেসিনের জীবাশ্মের ওপর নির্ভর করছিলেন। এখানে পার্মিয়ান বিলুপ্তির আগের ও পরের জীবনের এক প্রায় পূর্ণাঙ্গ নথি রয়েছে। তবে ১৯৩০-এর দশক থেকেই গবেষকরা বুঝতে পারেন, তানজানিয়া ও জাম্বিয়ার বেসিনগুলিতেও সমান সমৃদ্ধ তথ্যভান্ডার লুকিয়ে আছে। সাম্প্রতিক অভিযানে এই অঞ্চল থেকে সংগৃহীত জীবাশ্ম এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সংগ্রহ। ২০১৮ সালে গবেষক দলটি রুহুহু ও লুয়াঙ্গওয়ার পার্মিয়ান-উত্তর প্রাণীদের উপর বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছিল। এবার তাঁরা আরও পেছনে গিয়ে পার্মিয়ান সময়কালকে আলোকিত করেছেন। নতুন গবেষণায় আবিষ্কৃত হয়েছে সুড়ঙ্গ খননকারী সরীসৃপসদৃশ তৃণভোজী, যাদের ঠোঁটের মতো মুখ আর ছোট দাঁত ছিল। মহাবিলুপ্তির সময়ে এরা ছিল স্থলভাগের প্রধান উদ্ভিদভোজী। পাশাপাশি আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন প্রজাতির গর্গোনপসিয়ান। বিশাল দাঁতওয়ালা শিকারি, এবং এক নতুন প্রজাতির টেম্নোস্পন্ডিল, সালামান্ডারের মতো বৃহৎ উভচর প্রাণী। সিডরের ভাষায়, “আমরা এখন পানজিয়ার দুই ভিন্ন অঞ্চলের তুলনা করতে পারছি। দেখতে পাচ্ছি, বিলুপ্তির আগে ও পরে কোন প্রাণী টিকে গেল, কোনটি হারিয়ে গেল। এর ফলে সত্যিকারের প্রশ্ন তুলতে পারছি, যারা বেঁচে গেল তারা কিভাবে বাঁচলো।”

 

সূত্র : “Introduction to vertebrate evolution in the Permian rift basins of Tanzania and Zambia” by Christian A. Sidor and Kenneth D. Angielczyk, 7 August 2025, Journal of Vertebrate Paleontology.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × three =