আমাদের শরীরের একটি অত্যাবশ্যক অংশ মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে

আমাদের শরীরের একটি অত্যাবশ্যক অংশ মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩ অক্টোবর, ২০২৩

প্রতিটি মানুষের দেহে লক্ষ কোটি অণুজীবের এক জটিল জগৎ রয়েছে যা আমাদের জীবিত থাকাকালীন আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অণুজীবের জগৎ ও মানুষের পারস্পরিক নির্ভরতা, এই দুটি জীবের সুষ্ঠ জীবনযাপন করতে সাহায্য করে। এই মাইক্রোবিয়াল সিম্বিওন্টগুলো আমাদের খাদ্য হজম করতে, প্রয়োজনীয় ভিটামিন তৈরি করতে, সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে এবং অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে সহায়তা করে। পরিবর্তে, এই জীবাণু, যা বেশিরভাগই আমাদের অন্ত্রে বসবাস করে, তারা মানুষের শরীর থেকে খাদ্যের অবিচ্ছিন্ন সরবরাহ পায় ও একটি অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল, উষ্ণ পরিবেশে বাস করতে পারে। কিন্তু মানুষের মৃত্যুর পর এই সিম্বিওটিক জীবাণুদের কী হয়?
আমরা হয়তো অনেকেই ভাবি যে আমাদের শরীরে বসবাসকারী এই জীবাণুগুলো আমাদের সাথেই শেষ হয়ে যায়- একবার আমাদের শরীর শেষ হয়ে গেলে এই জীবাণুগুলো পরিবেশে আর বেঁচে থাকে না। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণায়, দেখা গেছে যে মানুষের মৃত্যুর পরে তার শরীরে থাকা জীবাণু কেবল বেঁচে থাকে তাই নয়, তারা আসলে মানুষের শরীরকে পুনর্ব্যবহার করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাতে নতুন জীবন বিকাশ লাভ করতে পারে। মানুষের মৃত্যুর পর, হার্ট সারা শরীরে অক্সিজেন বহনকারী রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে দেয়। অক্সিজেনের অভাবে কোশ অটোলাইসিস নামক প্রক্রিয়ায় নিজেদের হজম করা শুরু করে। সেই কোশের এনজাইম-যা সাধারণত শক্তি বা নিয়ন্ত্রিত উপায়ে বৃদ্ধির জন্য কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং ফ্যাট পরিপাক করে – ঝিল্লি, প্রোটিন, ডিএনএ এবং কোশ তৈরির অন্যান্য উপাদানের উপর কাজ করতে শুরু করে। এই সেলুলার ব্রেকডাউনের উপাদানগুলো সিম্বিওটিক ব্যাকটেরিয়ার খাবার হয়ে দাঁড়ায়। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া, যেমন ক্লোস্ট্রিডিয়া, মানুষের শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং পিউট্রাফ্যাকশন নামক একটি প্রক্রিয়ায় মানুষের শরীরকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলতে থাকে। অক্সিজেনের অভাবে শরীরের অভ্যন্তরে অ্যানেরোবিক ব্যাকটেরিয়া ফার্মেন্টেশনের মতো শক্তি-উৎপাদনকারী প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। পচনের ফলে শরীর থেকে এক গন্ধযুক্ত-গ্যাস নির্গত হয়।
মৃত্যুর পর যদি মানুষকে মাটিতে কবর দেওয়া হয়, তখন শরীর থেকে জীবাণুগুলো পচনশীল তরলের সাথে মাটিতে মিশে যায়। তারা একটি সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে প্রবেশ করে এবং মাটিতে একটি সম্পূর্ণ নতুন মাইক্রোবায়াল সম্প্রদায়ের মুখোমুখি হয়। মাটিতে যে ভিন্ন অণুজীবের জগৎ রয়েছে তাদের সঙ্গে এরা মিশে যায় কিন্তু টিকে থাকার লড়াইয়ে এরা পিছিয়ে পড়ে কারণ শরীরের অভ্যন্তরে এই জীবাণুরা এক স্থিতিশীল উষ্ণ জগতে বসবাস করত যেখানে তারা সর্বদা খাবার পেয়ে যেত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা অনুমান করে থাকি যে আমাদের জীবাণু আমাদের শরীরের বাইরে থাকলে মারা যাবে। কিন্তু এই গবেষণায় দেখা গেছে যে হোস্টের জীবাণুর ডিএনএ, মানুষের পচনশীল শরীরের নীচের মাটিতে, মাটির পৃষ্ঠে এবং শরীরের নরম কলা পচন ধরার কয়েক মাস বা বছর পরেও কবরে সনাক্ত করা যেতে পারে। তবে কী এই জীবাণুগুলো মানুষের মৃত্যুর পরেও জীবিত এবং সক্রিয় নাকি তারা কেবল সুপ্ত অবস্থায় পরবর্তী হোস্টের জন্য অপেক্ষা করছে? এই নতুন অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে যে প্রোটিন এবং নিউক্লিক অ্যাসিডের মতো বড়ো নাইট্রোজেন-ধারণকারী অণুকে আমাদের জীবাণুগুলো সম্ভবত অ্যামোনিয়ামে রূপান্তরিত করে এবং তারপর মাটিতে থাকা নাইট্রিফাইং জীবাণু এই অ্যামোনিয়ামকে নাইট্রেটে রূপান্তর করতে পারে। অনেক সময় দেখা গেছে যে একটি পচনশীল প্রাণীর কাছে উদ্ভিদের বিকাশ ঘটেছে, অর্থাৎ মৃত দেহের পুষ্টিগুলো বাস্তুতন্ত্রে পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের শরীরের জীবাণু এই চক্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আর তাই এইভাবেই মৃত্যুর পরেও আমরা বেঁচে থাকি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 4 =