আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মস্তিষ্কের কুয়াশা

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মস্তিষ্কের কুয়াশা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৮ অক্টোবর, ২০২৫

“আজকাল কিছুই মনে থাকে না!” কিংবা “মাথা যেন ধোঁয়াশায় ভরে যাচ্ছে”। কথাগুলি শুধু প্রৌঢ়দের মুখেই নয়, বরং তরুণদের মধ্যেও শোনা যাচ্ছে বারবার। যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক বিস্তৃত সমীক্ষা দেখিয়েছে, ৪০ অনূর্ধ্ব প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্মৃতি ও চিন্তাশক্তি হ্রাসের প্রবণতা বিগত দশকে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গবেষকরা একে আখ্যা দিয়েছেন ‘মস্তিষ্কের কুয়াশা বা ব্রেইন ফগ মহামারি’। ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪৫ লাখ মানুষকে নিয়ে এক জাতীয় টেলিফোনভিত্তিক সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে গবেষক দল এই ফলাফল পেয়েছেন। অংশগ্রহণকারীদের একটা সহজ প্রশ্ন করা হয়েছিল। “গত ১২ মাসে, শারীরিক, মানসিক বা আবেগজনিত কারণে কি আপনি নিয়মিতভাবে মনোযোগের ঘাটতি, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সমস্যায় পড়েছেন?” যাঁরা “হ্যাঁ” বলেছেন, তাঁদের ‘চিন্তাশক্তি বা স্মৃতিশক্তির সমস্যা’ রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। সেই তথ্য থেকেই এই মানসিক স্বাস্থ্যের সামগ্রিক প্রবণতা বিশ্লেষণ করেন। কোভিড-১৯ মহামারির ২০২০ সালের তথ্য বাদ দেওয়া হয়। কারণ, মহামারিকালীন উদ্বেগ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও ভাইরাসজনিত মানসিক প্রভাব ফলাফলকে বিকৃত করতে পারত। দশ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে স্মৃতি বা মানসিক সংকীর্ণতা–সম্পর্কিত সমস্যার কথা জানানো মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ২০১৩ সালে মোট প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৫.৩ শতাংশ মানুষ এমন সমস্যা অনুভব করতেন, ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৪ শতাংশে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে ১৮ থেকে ৩৯ বছর বয়সী তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে। এক দশকের ব্যবধানে এই গোষ্ঠীতে স্মৃতি দুর্বলতার হার ৫.১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯.৭ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। অন্যদিকে, ৭০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে এর বিপরীত প্রবণতা দেখা গেছে। ২০১৩ সালে যেখানে প্রায় ৭.৩ শতাংশ প্রবীণ স্মৃতিজনিত অসুবিধার কথা বলেছিলেন, ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬.৬ শতাংশে। গবেষণায় দেখা গেছে, আয় ও শিক্ষার স্তরও এই মানসিক দুর্বলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। নিম্নআয়ের মানুষদের মধ্যে এ প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি।বিপরীতে, উচ্চ আয় গোষ্ঠীতে এ হার ১.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে মাত্র ৩.৯ শতাংশে পৌঁছেছে। শিক্ষাগত পার্থক্যও স্পষ্ট। যাঁরা উচ্চ বিদ্যালয় শেষ করেননি, তাঁদের মধ্যে সমস্যা বেড়েছে ১১.১ থেকে ১৪.৩ শতাংশ, আর কলেজ ডিগ্রিধারীদের মধ্যে ২.১ থেকে ৩.৬ শতাংশ।তরুণদের মধ্যে এই বৃদ্ধিই সামগ্রিক প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। কেন এমন হচ্ছে, তার একক কোনো সদুত্তর নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি হতে পারে মানসিক চাপ ও দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগের প্রভাব, স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় কাটানো, ঘুমের ঘাটতি,অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস,স্থবির জীবনধারা, অথবা মহামারি-পরবর্তী মানসিক পরিবর্তনের ফল। তাছাড়া, এখন মানুষ নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি সচেতন, ফলে আগের তুলনায় এ ধরণের সমস্যা জানানোর প্রবণতাও বেড়েছে।

 

এই গবেষণা এক গভীর বার্তা দিচ্ছে- “তরুণ প্রজন্মের মস্তিষ্ক ও মনোযোগ ক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে”। এটি ভবিষ্যতে সমাজ, কর্মক্ষেত্র ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এখনই সময় সচেতন হওয়ার। মানসিক চাপ কমানো, পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাবার, ডিজিটাল স্ক্রিন দেখা কমানো এবং নিয়মিত ব্যায়াম – এগুলি ভবিষ্যতের মস্তিষ্কসংকট ঠেকাতে সাহায্য করতে পারে। অন্যথায়, “মস্তিষ্কের কুয়াশা” হয়তো আমাদের প্রজন্মের অদৃশ্য মহামারিতে পরিণত হবে। যেখানে স্মৃতি হারানোই হয়ে উঠবে নতুন দৈনন্দিনতা।

 

সূত্র : “Rising Cognitive Disability as a Public Health Concern Among US AdultsTrends From the Behavioral Risk Factor Surveillance System, 2013–2023” by Ka-Ho Wong, et.el; 24 September 2025, Neurology.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 2 =