আলোতে আলোতে ঢাকা

আলোতে আলোতে ঢাকা

Posted on ১২ আগষ্ট, ২০১৯

(এ ঘটনাটার সত্যি মিথ্যে জানি না, যদ্দূর বুঝলাম, তাবড় তাবড় পণ্ডিতেরা পর্যন্ত্য একমত হতে পারেন নি আদৌ এরকম কিছু হয় কি না বাস্তবে। ক্লোরোফিল অণু সূর্যের আলো থেকে শক্তি পেয়ে খেপে গিয়ে সেই শক্তিকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেয়। সেখানে সালোকসংশ্লেষের প্রথম ধাপের বিক্রিয়া হয়। বিতর্ক হচ্ছে কেমন করে সেই সৌরশক্তি খুব কম সময়ে, একটুও প্রায় না খুইয়ে, অত লাখ লাখ ক্লোরোফিল অণু পেরিয়ে বিক্রিয়ার কুরুক্ষেত্রে পৌঁছায়। কোয়ান্টাম টানেলিং বা কোয়ান্টাম কোহিয়ারেন্স বা এনট্যাংগলমেন্ট দিয়ে সত্যি সালোকসংশ্লেষ প্রভাবিত হয় কি না তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। আর এসব ঘটনা বিশদে বোঝাবার মত জ্ঞান এখনো অর্জন করে উঠতে পারি নি। তবে কিছু একটা হচ্ছে যাকে কেবল ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার আলোয় বুঝে ওঠা মুশকিল। এই তো জীবন, শ্রোয়েডিংগারদা, এই তো কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান!)

“আরো দূরে
আমার এই চেতনাকে সঙ্গী করে
যে তৃণভূমি আজ তুলছে আওয়াজ
সেখানে সোনারোদে বুনছে কোলাজ
আলোতে আলোতে ঢাকা
আলোতে আলোতে ঢাকা।”

গাইতে গাইতে কখন যে থাইলাকয়েডের বেড়া ডিঙিয়ে ফোটনমামা ক্লোরোফিল-মেসোর ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লো খেয়ালই করি নি! যখন খেয়াল হলো, তখন দেখি মেসো হাঁ করে তাকিয়ে মামার লেকচার শুনছে!
মামা বলছে, আরে দেখুন না, হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস মানে শুধু প্রোটনগুলো পড়ে ছিলো, ইলেকট্রনগুলো ওরকম গনগনে খাপ্পা মেজাজ সইতে পারে নাকি! তারা কখন পালিয়ে গোটা ব্যাপারটা প্লাজমা করে এনেছে ততক্ষণে। আরে সূর্যের কথা বলছি মশাই, চোখের সামনে দেখলুম জামাইবাবু, আরে বললে পেত্যয় যাবে না, সবই আজকাল দুর্নীতির আখড়া বুঝলেন কি না, সবই আজকাল পাইয়ে দেবার ধান্দা!

ফোটনমামার কথা শুনে ক্লোরোফিল-মেসো উত্তেজিত হয়ে শুধোলেন, বটে বটে, তা কিরকম শুনি?

মুখটাকে সুনীল মুখুজ্জের মত পাকিয়ে ফোটনমামা জানায়, এমনিতে তো হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস মানে প্রোটনে তো পজিটিভ চার্জের ইগো ঠাসা। মুখোমুখি হলেই এ ওকে ধাক্কা মারে। তা এরকম অবস্থায় দুটো প্রোটনকে একসাথে ধরে ঠুকে দিলেও তো আটকে কিছু হিলিয়াম নিউক্লিয়াস হওয়া সম্ভব নয়, মানে নিজে থেকে তো হবেই না। অথচ পৃথিবীর ছেলেমেয়েগুলো সেই ছোটবেলা থেকে জেনে আসছে,
সূর্যের ভেতরে হাইড্রোজেনের দুটো নিউক্লিয়াস জুড়ে হিলিয়ামের একটা নিউক্লিয়াস হয়, তাকে বলে নিউক্লিও-সংযোজন বিক্রিয়া, আর তার থেকে বেরনো শক্তিই সূর্যের শক্তি।

মেসো বললেন, আরে, আমিও তো সেরকমই জানি, ইয়ে মানে, দেশটাকে বাইরে থেকে দেখে তো এরকমই মনে হয়!

ফোটনমামা লাফ দিয়ে হাতে একটা চুটকি বাজিয়ে বলে উঠলো, তবে আর বলছি কি জামাইবাবু, ঐখানে ঐ পোকিতি না পোতীকী বলে একটা মেয়ে আছে না?

মেসো বললেন, আঃ, ওটা হলো প্রকৃতি। ঐ তো সবের মূলে, আহা, জয় শ্রীমতী প্রকৃতি। এই বলে হাতজোড় করে উপরে তাকিয়ে নমো করলেন বলে মনে হল!

ফোটনমামা সুর টেনে বললো, ইঃ! মূলে নয়, মূলে নয়, কান্ডে! আসল কান্ডটা তো ওরই প্ল্যান। ও যেই বলেছে, ছবি তুলবি তো গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়া, আর ওমনি দুটো প্রোটন একটু গায়ে গা ঠেকিয়ে ফেলেছে। ব্যস্, আর যায় কোথায়! এমনিতে দুজনের মধ্যে পজিটিভ চার্জের ইগোর বিরাট পাঁচিল, নিজেরা টপকাতে পারে না। কিন্তু তখনই প্রকৃতি কোয়ান্টাম দুনিয়ার নিয়মটা ওদের মনে করিয়ে দেয়। আরে সেই যে, সব কণারই ঢেউয়ের মতো ন্যাজ থাকে, যত ছোট কণা, তত ন্যাজ বড়ো, সেই নিয়মটা।

মেসো ঘাড় নেড়ে বললেন, হুঁ, আর্টিকেল ল্যাম্বডা, ধারা এইচ বাই পি, ডি ব্রগলির কানুন। আমারো আছে, তোরও আছে, এই দ্যাখ।

মামা বললো, আরে সে তো জানি। কিন্তু তাই দিয়ে কি কখনো জোচ্চুরি করেছি আমরা, বলুন দিকিনি? নিজে থেকে পাঁচিল টপকাতে পারে না বলে বলে দিলো, ওপারেও ওর ন্যাজ আছে, এপারেও ওর ন্যাজ আছে। কাজেই, দুটোই এক, ইগো ফিনিশ! পাঁচিল থাকা সত্ত্বেও দুজনে মিলে হাতে হাত মিলিয়ে নিলো! এ যদি দুর্নীতি না হয়, তবে আর দুর্নীতি কিসে আছে বলুন জামাইবাবু? আবার এমনি বদ, ঘটা করে তার নাম রেখেছে, “কোয়ান্টাম টানেলিং”!

মেসো গম্ভীর হয়ে বললেন, না রে ফোটন, ওদের ভেতরে হয়তো ছোটো ছোটো ছেলের মত দুটো ঢেউ ঢেউ সত্তা ছিলো, যারা মিলতে পারছিলো না বাইরের বড়ো মানুষদুটোর ইগোর চোটে! সুযোগ পেয়ে ভুল বোঝাবুঝি মিটলো হয়তো।

মামা বললো, কি সব ফিলোসফি আওড়ালে মাইরি, ভরবেগের উপর দিয়ে বেরিয়ে গেলো! এ, শোনো না জাম্বু, ওসব ছাড়ো! আমি সেই দেড় হাজার লাখ কিলোমিটার থেকে জাস্ট আট মিনিট কুড়ি সেকেন্ডে তোমার বাড়ি আসছি, শুধু একটাই কারণে, ভাবতে পারছো!

মেসো হাত নেড়ে বললেন, আরে এতে আর ভাবার কি আছে? দিনের আলো ফুটলেই তো তোমাদের “সৌরশক্তি আনাও, গ্লুকোজ বানাও” বলে উপদ্রব শুরু হয়! আমার এই ম্যাগনেসিয়াম আয়নটা দজ্জাল গিন্নি হয়ে মাঝে বসে না থাকলে কবেই তোমরা এই অণুর বাড়িটা ঝাঁকিয়ে ভেঙে ফেলতে। ঢের ডেঁপোমি করেছো, এবার উদ্দেশ্যটা খোলসা করে বলো দিকি!

ফোটনমামা ভারি লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বললো, জামাইবাবু, ইয়ে মানে, বলছিলাম কি, আপনাদের এই আলোচাষের কমপ্লেক্সটা থেকে ঐটা কদ্দূর?

কোনটা? মেসো অধৈর্য্য হয়ে বলেন, আরে কার্বনডাইঅক্সাইড না জল, কার কথা বলছো বলোতো?

ফোটনমামা বলে, আরে না না, ওরা নয়, আমি জানতে চাইছি ঐ উৎসেচকীয় কুরুক্ষেত্রটা, ওটা এখান থেকে বেশিদূর হলে একটু হেল্প লাগবে আপনার, হেঁ হেঁ!

মেসো বললেন, অ! তা সে তো তোমার ভাবার কথা নয়, বাবু আছে, ও নিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে তোমার সৌরশক্তিটুকু। বাবু, অ্যাই বাবু, কোথায় গেলি!

মামা এবার অধৈর্য্য হয়ে বলে উঠলো, আরে সে তো জানি, ঐখানেই একটু কম্প্রোমাইজ করলে ভালো হতো। আরে, পিকোসেকেন্ড বোঝেন, পিকোসেকেন্ড? এক সেকেন্ডের দশহাজার কোটিভাগের একভাগে আমার শক্তিটুকু সেখানে পৌঁছনো চাই, একটুও না ফেলে ছড়িয়ে! এভাবে বাড়িতে বাড়িতে মাতালের মতো ঠোক্কর খেতে খেতে গেলে পোচ্চুর টাইম লস হয়ে যাবে! গ্লুকোজকে কি কৈফিয়ত দেবো বলুন তো! যাক গে, ডাকুন বাবুকে!

বাবু হলো আমার মাসতুতো ভাই ইলেকট্রন। ও যখন কোথাও যায়, যে জায়গাটা ফোকলা পড়ে থাকে, সেটাই আমি। আমায় ইংরেজিতে “হোল” মানে গর্ত বলে। খোলা ইলেকট্রন আর ফোকলা হোলে মাসতুতো ভাই মানে যাকে পণ্ডিতেরা বলেন, এক্সাইটন। সে যাই হোক, ভাইটা আমার হেব্বি স্মার্ট। ফোটনমামার কথা শুনেই বুঝে গেছে কি করতে হবে! ঝটাকসে কোত্থেকে উদয় হয়ে বলে, আরে মামু, এ হাল্লু করে একটু ন্যাজ নাড়িয়ে তোমার এনার্জি পুরো সেখানে ট্রান্সফার করে দেবো। ডোন্ট ওরি! তুমি তো জানো মামু, কতরকম অবস্থা আমি একসাথে মেইনটেইন করি।

ফোটনমামার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ভাগ্নেকে ঠিকই বোঝানো গেছে তাহলে। এই না হলে কোয়ান্টামীয় সঙ্গত! একটাই ইলেকট্রন বহুরূপে সম্মুখে অবতীর্ণ হয়ে গোটা এনার্জিটা স্রেফ পিকোসেকেন্ডে উৎসেচকীয় কুরুক্ষেত্রে বয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারে। তারজন্য সবকটা ক্লোরোফিল অণু ছুঁয়ে আসার দরকারই নেই।

এসব ভেবে ফোটনমামা কিছুটা আশ্বস্ত হলেও, মেসো দেখলাম সমানে গজগজ করতে লাগলো এই বলে, ব্যাটা, নিজে সূর্যের দুর্নীতি নিয়ে লেকচার দিতে এসেছিলো, এখন এখানে যেটা ঘটাবে সেটা বুঝি দুর্নীতি নয়, অ্যাঁ? এতগুলো ক্লোরোফিল অণুর ঘর একটা একটা করে কোথায় পার হয়ে আলোকদশার বিক্রিয়া শুরু করবে, তা না খালি শর্টকাট। এইজন্যি ফোটনদের “রেস্ট মাস” হয় না! ছি ছি, দেশটা উচ্ছন্নে গেলো!

পাশের ঘরে পোষা প্রোটনটাকে আদর করতে করতে শুনতে পেলাম, ফোটনমামা উদাত্ত কন্ঠে গান ধরেছে,

“আমার বুকে সূর্যের বাসা
আমার চোখে বাঁচার তাগিদ
আমার মনে হিমালয় আশা
সময় কিনে চাইনি রশিদ
আমার ঈশ্বর চিনে নেবে আমায়
আছি দাঁড়িয়ে তার দরজায়
রোজ এক স্বপ্ন দেখা
আলোতে আলোতে ঢাকা
আলোতে আলোতে ঢাকা
আলোতে আলোতে ঢাকা।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine − five =