আলো দূষণ আকাশগঙ্গা দেখতে বাধা দিচ্ছে

আলো দূষণ আকাশগঙ্গা দেখতে বাধা দিচ্ছে

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৪ আগষ্ট, ২০২৪
আকাশগঙ্গা

অন্তত এক লাখ বছর যাবত আমরা, পৃথিবীর বুকে বাস করছি। প্রকৃতির সন্তান হিসেবে আমরা জঙ্গল, নদ- নদী, পাহাড়, সমুদ্র অন্বেষণ করেছি। তেমনই প্রাচীনকাল থেকে আমরা রাতের দিকে তাকিয়ে তারা, নক্ষত্র খচিত আকাশ দেখেছি, প্রকৃতিকে চেনার চেষ্টা করেছি, তার রহস্য বোঝার চেষ্টা করেছি। আমরা দেখেছি আমাদের উৎপত্তিস্থল আকাশগঙ্গার মেঘরাশি। সারা বিশ্বের সংস্কৃতিতে এই আকাশগঙ্গা দর্শন ঘিরে নানা গল্প, উপকথা চালু রয়েছে। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে ৩০০ কোটি মানুষ রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আর আকাশগঙ্গা দেখতে পান না। এর ফলে মহাজগতের সাথে আমাদের সংযোগ, সময়ের গভীরতাও ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। এই ক্ষতির জন্য দায়ী কে জানেন – আলো দূষণ। এটা তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক সমস্যা। মোটামুটি এক শতাব্দী আগেও, পৃথিবীর বড়ো শহরের মাথার ওপরের আকাশ পর্যাপ্ত অন্ধকার ছিল। আর রাতের বেলা তাকালেই দেখা যেত আকাশগঙ্গার বায়বীয় মেঘ, মহাবিশ্বের দূরতম প্রান্তের নক্ষত্রের জ্বলজ্বলে আলোর কণা।
আলো দূষণ হল ঊর্ধ্বমুখী আকাশের দিকে আলোর ছিটকে পড়া দীপ্তি। আলো রাতের বেলা পৃথিবীর বুকের নানা জিনিস দেখতে সাহায্য করে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেই আলোই দূষণ সৃষ্টি করতে পারে, যদি তা অপ্রয়োজনীয় আলো হয়, বা আলোর আতিশয্য হয়, বা দুর্বল ডিজাইনের জন্য এমন আলো হয় যা যথাস্থানের পরিবর্তে অন্যান্য স্থানেও ছড়িয়ে পড়ে। এতে একটা এলাকায় আলো দূষণ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। আলো দূষণের উৎসও বিভিন্ন তবে দূষণে বেশি অবদান মূলত রাস্তার আলোর। একটা শহরের আলো দূষণের ২০-৫০% ক্ষেত্রে দায়ী রাস্তার আলো। এছাড়া যে উৎসগুলো দূষণের জন্য দায়ী তারা হল – ডিম্বাকৃতির ফ্লাডলাইট, বিলবোর্ড আর আমাদের বাড়ির ভেতরের ও বাইরের আলো।
হাজার হাজার বছর ধরে, মানুষ আকাশগঙ্গা বিশদে পর্যবেক্ষণ করেছে। যেখানে আকাশগঙ্গার ধুলো তার পেছনে থাকা তারার আলো আটকে দিচ্ছে সেই অন্ধকারময় অঞ্চলও তারা দেখেছেন। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী এবং টরেস স্ট্রেট দ্বীপবাসীরা গ্রেট সেলসিয়াল এমুর পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড রেখেছেন। এটা দক্ষিণ ক্রস নক্ষত্রমণ্ডলের কাছাকাছি আকাশগঙ্গার অন্ধকার ধূলিকণা দ্বারা গঠিত, কোলস্যাক নেবুলা নামক একটা এলাকা। মোটামুটি এক শতাব্দী আগে “আলোর শহর” – প্যারিসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশে এই দুর্দান্ত দৃশ্য দেখা যেত। ১৮৮০ থেকে ১৯১০ দশকের শেষদিক অবধি ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্যারিস মানমন্দির থেকে অনেকগুলো ছায়াপথ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু এই সময় থেকে আলো দূষণ বাড়তে থাকে, আর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন মানমন্দির, মাউন্ট স্ট্রোমলো মানমন্দির এগুলো থেকে আকাশ পর্যবেক্ষণ বন্ধ করে দিতে হয়। কারণ আলোর তীব্রতা জ্যোর্তিবিজ্ঞানীদের আকাশ পর্যবেক্ষণে বাধার সৃষ্টি করছিল। শহর থেকে সরিয়ে দূরবর্তী স্থানে স্থাপিত হওয়া মানমন্দিরও কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। সাইডিং স্প্রিং মানমন্দির যা ক্যানবেরা থেকে যেতে ৮ ঘণ্টা সময় লাগে, সেটাও ৪৫০ কিলোমিটার দূরে সিডনির আলোর শিকার। এমন আলো লাগানো উচিৎ যার আলো ওপরের পরিবর্তে নিচের দিকে ছড়াবে। ক্যানবেরায় সরকার থেকে এই পদক্ষেপ নেওয়ার পর, ৩০% আলো দূষণ কমেছে। আলো ঠিকমতো নেভানো দরকার। কি রঙের আলো লাগানো হচ্ছে, তা দেখাও জরুরি। উজ্জ্বল সাদা এলইডি ব্যবহার করার পরিবর্তে, উষ্ণ রঙের আলো ব্যবহার করা ভালো, যা আমাদের চোখ, ঘুমের চক্র, স্থানীয় প্রাণীদের জন্য আলোর দূষণ কমানোর পক্ষে ভালো।