ইঁদুর ড্রাইভার

ইঁদুর ড্রাইভার

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২২ নভেম্বর, ২০২৪

২০২০ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার গবেষকরা হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ইঁদুরদের গাড়ি চালানো শিখিয়ে। তাঁরা ইঁদুরদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন দানাশস্য আর প্লাস্টিকের তৈরি ছোটো ছোটো মোটর গাড়িতে লাগানো তারের ওপর চাপ দিয়ে “গাড়ি চালিয়ে” কীকরে ঘরের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া যেতে পারে। রিচমন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিহেভিয়রাল নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক কেলি ল্যামবার্ট বলেন, “দেখতে না দেখতে ওরা গাড়ি চালিয়ে একটা বিশেষ ধরনের খাবার নিখুঁতভাবে খুঁজে নিতে শিখে আমাদের অবাক করে দিয়েছিল”। তিনি আরও লক্ষ্য করেন, বেশ প্রশস্ত জায়গায় বন্ধুবান্ধব আর খেলনাপাতি ছড়ানো থাকলে তারা অনেক তাড়াতাড়ি এইসব কৌশল শিখে নেয়।
তাঁদের এ গবেষণা এগিয়ে চলেছে। সম্প্রতি অধ্যাপক ল্যাম্বার্ট দেখেন, গাড়ি চালানো শেখার কর্মসূচিতে “ওরা অপ্রত্যাশিতভাবে আগ্রহী ও উৎসাহী হয়ে উঠেছে। কখনো কখনো গাড়ির মধ্যে লাফিয়ে উঠে পড়ে গাড়ি চালু হবার আগেই তথাকথিত ‘লিভার ইঞ্জিনে’র ওপর চাপ দিতে আরম্ভ করে দেয়”। একদিন দেখেন, “আমি ল্যাবরেটরিতে ঢোকবা-মাত্র গাড়ি-চালানোয় তালিম-নেওয়া তিনটে ইঁদুর পরম উৎসাহে ছুটতে ছুটতে খাঁচার ধারে এসে লাফালাফি করতে আরম্ভ করে দিল, ঠিক যেমন আমার পোষা কুকুরটা করে বেড়াতে যাওয়ার সময়”।
স্পষ্টতই ওদের কোনো একটা ইতিবাচক অনুভূতি হচ্ছে – একটা উত্তেজনা আর একটা প্রত্যাশা। এটাকে কি আনন্দ বলা যায়? এই নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করলেন তাঁরা। ইতিবাচক একটা কাম্য ঘটনা ঘটতে চলেছে এই প্রত্যাশা কীভাবে প্রাণীদের মস্তিষ্কর স্নায়ু-ক্রিয়াকে রূপ দেয়, এটাই হয়ে উঠল তাঁদের গবেষণার মূল বিষয়। ‘ওয়েইট ফর ইট’ (একটু দাঁড়াও) নামে একটা নতুন গবেষণা প্রক্রিয়া চালু করলেন অধ্যাপক ল্যাম্বার্ট ও তাঁর ছাত্রী কিটি হার্টভিগ্‌সেন। প্রত্যাশার তীব্রতা বাড়ানোর এবং পুরস্কারের জন্য অপেক্ষা করানোর একটা কৌশল বার করলেন তাঁরা। ইঁদুরদের বিশেষ প্রিয় একটা খাবার খাঁচায় রেখে পনেরো মিনিট তাদের সেই খাবার থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করা হল। শুধু তাই নয়, খাওয়ার আগে তাদের একটা পরীক্ষা দিতে হল : সূর্যমুখী ফুলের দানার খোসা ছাড়ানো। এই সময় তাদের মস্তিষ্কের মধ্যে কী ঘটছে সেটার ওপর নজর রাখা হল। দেখা গেল, অপেক্ষা করতে বাধ্য হওয়ার ফলে তাদের মস্তিষ্ক “নিরাশাসূচক বোধের ধরন থেকে আশাব্যঞ্জক বোধের ধরনে বদ্‌লে গেছে”। শুধু তাই নয়, “বোধ সংক্রান্ত কাজের ভার তারা আরও ভালোভাবে নিষ্পন্ন করতে পারছে, সমস্যা সমাধানের পথ আরও নিপুণ কৌশলে বার করতে পারছে”। যেসব ইঁদুরদের পুরস্কার পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি, যারা তৎক্ষণাৎ খাবার পেয়ে গেছে, তাদের তুলনায় এদের সাফল্য উন্নত মানের।
পুরস্কারের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে যাদের বাধ্য করা হয়েছিল সেইসব ইঁদুরদের আচরণে কতকগুলো বাহ্য লক্ষণও ফুটে উঠল। একদিন দেখা গেল, তালিম-প্রাপ্ত একটা ইঁদুর ইতিবাচক অভিজ্ঞতা লাভের প্রত্যাশায় তার ল্যাজটা খাড়া করে ডগাটা হুকের মতো পাকিয়ে রেখেছে, পুরোনো কালের ছাতার বাঁটের মতো। আগে জানা ছিল, ইঁদুরদের মরফিন দিলে তাদের মধ্যে “মস্তির” অনুভূতি জাগে আর তখন তারা ওইভাবে ল্যাজ খাড়া করে তোলে। কিন্তু এক্ষেত্রে মরফিন না-দিয়েই এই ইঁদুরগুলির মধ্যে আনন্দের অনুভূতি জাগছে। যেসব ইঁদুর ওইভাবে তালিম পায়নি তাদের মধ্যে কিন্তু এই লক্ষণ এত বেশি দেখা যায় না।
গাড়ি চালানোয় তাদের এত আগ্রহ-উদ্দীপনা কেন, তা যাচাই করবার জন্য ইঁদুরদের সামনে দুটো বিকল্প রাখা হল। ১) খাবারটা পাবার জন্য পায়ে হেঁটে একটুখানি পথ অতিক্রম করা; ২) গাড়ি চালিয়ে ঘুরপথে খাবারের দিকে চলা। দেখা গেল তিনটের মধ্যে দুটো ইঁদুর গাড়ি চালানোর লোভে ওই ঘুরপথটাই বেছে নিল।
অধ্যাপক ল্যাম্বার্ট বলেন, “ মানুষই হোক কিংবা অন্য প্রাণীই হোক, সকলকেই জীবনের নানা অপ্রত্যাশিত দিকের মোকাবিলা করতে হয়। ইতিবাচক অভিজ্ঞতা ঘটার প্রত্যাশা, জীবনের পুরস্কারগুলির সন্ধানে এগিয়ে চলার কাজে প্রাণীদের সহায়তা করে। তাৎক্ষণিক তৃপ্তির জগতে দৈনন্দিন আচার আচরণে মস্তিষ্কের স্নায়ুক্রিয়া কীভাবে প্রাণীদের নির্দেশ দেয় সে ব্যাপারে এই ইঁদুররা কিছু অন্তর্দৃষ্টি সঞ্চার করতে পারে”। “ওরা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নিছক সুইচ টিপে তাৎক্ষণিক পুরস্কার পাওয়ার বদলে পরিকল্পনা করে, প্রত্যাশা করে, যাত্রাপথটকে উপভোগ করাই হয়তো সুস্থ মস্তিষ্কের চাবিকাঠি”।
(সূত্র: Andy Gregory, Nature/Independent, 19 November)