ইউরোপের পক্ষী সংকট: ভুল পরিকল্পনা

ইউরোপের পক্ষী সংকট: ভুল পরিকল্পনা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৮ অক্টোবর, ২০২৫

সমগ্র ইউরোপ জুড়ে পাখির সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। আজ নয়,  টানা শতাব্দী জুড়ে বহু প্রজাতির পাখি নীরবে হারিয়ে গেছে । আসলে অধিকাংশ সংরক্ষণ পরিকল্পনা শুরুই হয়েছিল ভুল সময় থেকে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, পাখির সংখ্যা কমতে শুরু করেছিল ১৯৭০-এর দশকের অনেক আগেই, কিন্তু  পরিকল্পনাগুলো ওই সময়টাকেই স্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে ভেবে বসেছিল।

১৯০০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ১৭০টি ইউরোপীয় পক্ষী প্রজাতির তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, সংরক্ষণ পরিকল্পনাগুলি প্রায়ই ভুল সময় থেকে শুরু করা হয়েছে , ফলে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ বোঝা যাচ্ছে না।

গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ফ্রান্সের ট্যুর ডু ভালাট ও ফিনল্যান্ডের টার্কু বিশ্ববিদ্যালয়ের এলি গাজে । তাঁর দল দেখেছেন, অনেক প্রজাতির সংখ্যা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু আধুনিক পক্ষী পর্যবেক্ষণ ও গণনা শুরু হয়  ১৯৭০-এর দিকে। তাই অনেক সংরক্ষণ প্রকল্প ভুল করে এই সালকেই প্রকৃত মানদণ্ড ধরে এগোয়।

এ ধরণের ভুলকে বলা হয় “শিফটিং বেস লাইন সিনড্রোম ”। অর্থাৎ, এটি এমন এক মানসিক বা ধারণাগত অবস্থা, যেখানে মানুষ সময়ের সাথে সাথে পরিবেশের বা প্রাকৃতিক ব্যবস্থার অবনতিকে নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতি হিসেবে মেনে নিতে শুরু করে। মোটকথা,  প্রতিটি প্রজন্ম পৃথিবীকে যেমন অবস্থায় দেখে, সেটাকেই স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক মনে করে। কিন্তু আগের প্রজন্মের তুলনায় প্রকৃতি ইতিমধ্যেই অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত বা পরিবর্তিত হয়ে গেছে।  ধীরে ধীরে মানুষ প্রকৃত পরিবেশের ধারণা হারিয়ে ফেলে । যেমন আগে কোনো নদীতে প্রচুর মাছ ছিল। এখন মাছ কমে গেছে, কিন্তু নতুন প্রজন্ম মনে করছে এই কম সংখ্যাই হয়তো স্বাভাবিক। ফলে প্রকৃত অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না অবনতি হচ্ছে সেটা তারা বুঝতে পারছে না।

ঐতিহাসিক রেকর্ড, পুরনো পর্যবেক্ষণ নোট, এবং আধুনিক তথ্য মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা পুরো এক শতাব্দীর পরিবর্তনের মানচিত্র এঁকেছেন। দেখা গেছে, অনেক জলচর ও সামুদ্রিক পাখি   বহু দশক ধরে টিকে থাকার লড়াইয়ে হারছে। যেমন ব্ল্যাক টার্ন এবং কর্নক্রেক প্রভৃতি।  প্রজাতি গবেষকদের মতে, এদের জন্য অবিলম্বে বিশেষ সংরক্ষণ উদ্যোগ প্রয়োজন।

এদের পতনের মূল কারণ একটাই ,সে হল মানুষ।  জলাভূমি শুকিয়ে ফেলা, কৃষিক্ষেত্রের সম্প্রসারণ, দূষণ, অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং অবৈধ শিকার – এসব কারণে পাখিদের বাসস্থান ধ্বংস হচ্ছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো জলবায়ু পরিবর্তন এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। যে জলাভূমিগুলো একসময় ছিল জীবনের আশ্রয়, সেগুলো আজ পরিণত হয়েছে পতিত জমিতে।

তবে সব গল্পই কেবল হারানোর  সেটা নয়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রেটার ফ্লেমিংগো একসময় পশ্চিম ইউরোপ থেকে প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও বাসস্থান পুনর্গঠনের ফলে তারা আবার ফিরেছে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে। একইভাবে গ্রেট করমোরান্ট-এর সংখ্যা অনেক অঞ্চলে বেড়েছে। তবুও গবেষকরা সতর্ক করেছেন :  এই পুনরুদ্ধার মানেই  কিন্তু পুরনো প্রাচুর্যে ফেরা নয়, বরং একটি নতুন ভারসাম্য তৈরি হওয়া।

গবেষকরা বলছেন, বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হলে বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি- বছর বেছে নিতে হবে। সেটা কোনোমতেই ১৯৭০ নয়।  তারও আগে থেকে পরিবর্তনের ইতিহাস দেখতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ, নাগরিকদের অংশগ্রহণ, এবং উন্মুক্ত তথ্যভাণ্ডার ভবিষ্যতের সংরক্ষণে বড় ভূমিকা রাখবে। যদি মূল্যায়ন করা ৪০% প্রজাতি নিয়েই ভুল ভিত্তিতে পরিকল্পনা চলে, তাহলে ইউরোপের পক্ষী সংরক্ষণ প্রকল্পগুলো প্রকৃত পুনরুদ্ধারের বদলে কেবল ক্ষতির সীমার ভেতরেই ঘুরপাক খাবে।

তাই আজকের সংরক্ষণ মানে শুধু সংখ্যায় ফেরা নয় বরং ইতিহাসকে স্মরণ করে প্রকৃত ভারসাম্যে ফিরে যাওয়া।

 

সূত্র:  Shifting the baseline for waterbird and seabird conservation in europe, risk assessment over one century by Elie Gaget,  Jon E.Brommer ,Thomas Galewski ,et.al; published in Biodiversity and Conservation,(27.09.2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 5 =