আমেরিকার প্রথম ন্যাশেনাল পার্ক, ইয়েলোস্টোন, যুগ যুগ ধরেই বিজ্ঞানীদের কাছে এক ধাঁধার বিষয়। পুর্বে এই পার্ককে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা পায়ে হেঁটে বা উপর থেকে ছবি তুলে তাঁদের গবেষণা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু আজ এক সুবিশাল নতুন ডিজিটাল তথ্যাদির কল্যাণে প্রায় ১-মিলিয়ন-হেক্টরের এই ন্যাশেনাল পার্ক গবেষকদের নখদর্পণে রয়েছে।
৯ই অক্টোবর ২০২২-এ, জিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ আমেরিকা কানেক্ট্স-এর সভায় দুজন গবেষক রিপোর্ট করেছেন যে, ইয়েলোস্টোন পার্কের ভিতরে বা তার আশপাশের এলাকায় হাজারেরও বেশি ধ্বস বা landslides ঘটেছে যার বেশিরভাগই সম্ভবত হাজার হাজার বছর আগে ঘটেছে আবার কিছু এখনও ঘটে চলছে।
ইয়েলোস্টোনের এই ধ্বসের ম্যাপিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই ধ্বস বহু রাস্তা এবং সেতু বিকল করে দেয়। প্রতি বছর যে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী পার্কে বেড়াতে আসেন তারা হাতেগোনা কয়েকটা প্রবেশ পথের মাধ্যমে ইয়েলোস্টোনে প্রবেশ করেন, যার মধ্যে সম্প্রতি একটা প্রবেশ পথ বন্যার পরে কয়েক মাস ধরে বন্ধ ছিল।
২০২০ সালে, ইয়েলোস্টোন পার্কের কয়েকশো মিটার উপরে দিয়ে একটা ছোটো বিমান পাঠানো হয় যাতে একটা লেজার মেশিনের মাধ্যমে গবেষকরা সেখানকার ভূমিপৃষ্ঠ সম্বন্ধে একটা ধারণা গঠন করেন। এই ধরনের “light detection and ranging” বা lidar (লাইডার) প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষকরা একটা বড়ো অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি করেন ও তার বিবরণ প্রকাশ করেন যা প্রায়শই চোখের আড়ালে থাকে। পোকাটেলোর আইডাহো স্টেট ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানী কাইরা বোর্নং বলেছেন, “আমরা মাটির পৃষ্ঠকে এমনভাবে দেখতে পাচ্ছি যেন কোনো গাছপালা নেই”। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাজন জঙ্গলের গভীরে প্রাক-কলম্বিয়ান বসতিগুলোও চিহ্নিত করা হয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে দ্বারা পরিচালিত একটা প্রকল্পে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাপ করার জন্য এই লাইডার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
বোর্নং এবং ভূ-প্রকৃতিবিদ বেন ক্রসবি ইয়েলোস্টোনের তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে এমন কিছু জায়গার সন্ধান পেয়েছিলেন যেখানে ভূ-প্রকৃতি প্রথমে তুলনামূলকভাবে মসৃণ ছিল এবং পরে ধ্বসের কারণে সেখানকার মাটি এবং শিলা সরে গিয়ে জায়গাটা এবড়োখেবড়ো হয়ে পড়ে। গবেষকরা ইয়েলোস্টোনের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হাজারেরও বেশি ধ্বস চিহ্নিত করেছেন যার বেশিরভাগই পার্কের সীমানার কাছাকাছি অবস্থিত। হুইটম্যান কলেজের ভূতত্ত্ববিদ লাইম্যান পারসিকো, যিনি এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁর মতে ইয়েলোস্টোনের ভৌগলিক চিত্র থেকে এই বিষয়টা স্পষ্ট যে পার্কটা একটা আগ্নেয়গিরির উপরে অবস্থিত এবং পূর্বে অগ্ন্যুৎপাতের সময় পার্কের বেশিরভাগ অংশ লাভায় ছেয়ে গিয়েছিল।
ইয়েলোস্টোন ন্যাশেনাল পার্কের অনেক ধ্বস প্রবণ এলাকার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে কিছু খাড়াই ভূখণ্ডও রয়েছে। বেশ কয়েকটা জায়গায়, দেখা গেছে যে ধ্বসের ধ্বংসাবশেষের উপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে যার অন্যতম উদাহরণ হল ইয়েলোস্টোনের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত হাইওয়ে ১৯১। এই হাইওয়ের উপর নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই হাইওয়ে দিয়েই ধ্বস প্রবণ এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গাড়ি চলাচল করে এবং বোর্নং বলেছেন, “এটা মন্টানার ব্যস্ততম রাস্তাগুলোর মধ্যে একটা”।
ক্রসবির মতানুসারে ইয়েলোস্টোনের এই ভূমিপ্রকৃতি থেকে আরও অনেক কিছু শেখার আছে। লাইডার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যেমন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ বা ভূ-আলোড়ন সম্বন্ধে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে যা যুগান্তরকারী হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।