
ইয়োডেলিং হল গান গাইবার এক কায়দা। এতে এক স্বরগ্রাম থেকে লাফ দিয়ে দিয়ে ঝটিতি অন্য স্বরগ্রামে ওঠানামা করে কণ্ঠ। সুইটজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশে এর খুব চল আছে। আমাদের দেশে কিশোরকুমার এই ইয়োডেলিং-এ ওস্তাদ ছিলেন। কী কৌশলে কণ্ঠ থেকে এই অত্যন্ত দুরূহ স্বরক্ষেপণ সম্ভব, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের প্রচুর কৌতূহল। সম্প্রতি অ্যাংলিয়া রাস্কিন এবং ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা যে-কাজ করেছেন তার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে ফিলজফিক্যাল ট্রানজ্যাকশন্স অব দ্য রয়াল সোসাইটি ‘বি’-তে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ইয়োডেলিং-এর আসল ওস্তাদ হল লাতিন আমেরিকার প্রাইমেটরা। কী করে এরা কণ্ঠ থেকে কতকগুলি বিচিত্র স্বর উৎপাদন করে সে বিষয়ে আলোকপাত করেছেন গবেষকরা।
জানা গেছে, এই ফিনফিনে পাতলা ঝিল্লিগুলি প্রাইমেটদের কণ্ঠনালীর ধ্বনিদ্বারের মাথায় অবস্থিত। এগুলির দৌলতেই বাঁদররা তাদের ডাকের মধ্যে কতকগুলি স্বরভঙ্গ ঘটাতে পারে। তারা যখন ধ্বনি উৎপাদনকে ধ্বনিদ্বার থেকে ধ্বনি-ঝিল্লিতে ঠেলে তুলে দেয়, তখন স্বরভঙ্গ ঘটে। তখন খুব দ্রুত নানা স্বরগ্রামে ওঠানামা করে তাদের কণ্ঠ। মানুষ গায়ক-গায়িকাদের ইয়োডেলিং-এর সঙ্গে এর মিল থাকলেও বাঁদুরে ইয়োডেলিং-এর কম্পাঙ্ক-পাল্লা অনেক বিস্তৃত। এই গবেষণা চালানোর জন্য সিটি স্ক্যান আর কম্পিউটার সিমুলেশন প্রকৌশলের পাশাপাশি ব্যাপক বহিরঙ্গন গবেষণা চালানো হয়েছে বলিভিয়ার লা সেন্দা ভের্দে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে। সেখানে গবেষকরা হরেক প্রাইমেটের ডাক রেকর্ড করে তা নিয়ে চর্চা ও বিশ্লেষণ করেছেন। দেখা গেছে, মেক্সিকো থেকে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত প্রসারিত অঞ্চলের আমেরিকান বাঁদরদের ধ্বনিঝিল্লিগুলি সবচেয়ে বড়ো। মনে হয় এই পাতলা পাতলা ফিতের মতো কোষকলাগুলো তাদের কণ্ঠ থেকে উৎপন্ন ধ্বনির বিপুল বৈচিত্র্য সাধানে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এরা অতি-উচ্চকিত ইয়োডেলিং-এ পটু, যার পাল্লা মানুষের কণ্ঠর স্বর-পাল্লার তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। মানুষের কণ্ঠ এক নিমেষে বড়োজোর এক স্বরগ্রাম ওঠানামা করতে পারে, কিন্তু এদের পাল্লা তিন স্বরগ্রাম। গবেষণাপত্রটির প্রধান রচয়িতা ডঃ জেকব ডান বলেছেন, “এ থেকে বোঝা যায় বাঁদররা কীভাবে তাদের কণ্ঠনালীর মধ্যে বিবর্তিত এই ধ্বনিঝিল্লির বৈশিষ্ট্যটিকে কাজে লাগিয়ে ঢের বড়ো পাল্লার ডাক উৎপাদন করতে পারে। এই অতি-উচ্চকিত ইয়োডেলিং-ও তার অন্তর্গত। প্রাইমেটদের জটিল সামাজিক জীবনযাত্রায় এর প্রয়োজন আছে, কারণ তাদের নানা ধরণের ধ্বনি-বার্তা প্রেরণ করতে হয়’, অন্যদের আকর্ষণ আদায় করার জন্য, নিজেদের পরিচয় দেওয়ার জন্য। আর একজন প্রধান গবেষক ডঃ ক্রিস্টিয়ান হের্বস্ট বলেছেন, ভাষার অভাব ওরা এইসব ধ্বনিপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে মিটিয়ে নেয় মস্তিষ্ক-নিয়ন্ত্রিত জটিল স্নায়ুবর্তনী ছাড়াই। মানুষের কণ্ঠধ্বনি-বিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক টেকুম্সে ফিচ জানিয়েছেন, ওই ঝিল্লিই কিন্তু বাঁদরদের কণ্ঠকে বেসামাল করে দিয়েছে। ‘মানুষের বিবর্তনের পথে ওই ঝিল্লিগুলি হারিয়ে গেছে হয়তো মানুষের গলার সুর আর কথার সুস্থিতি আনবার জন্যই’।