
উত্তরায়ণ অথবা গ্রীষ্মকালীন অয়নদিবস (Summer Solstice) কেবলমাত্র ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ নয়, এটি সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর বার্ষিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ জুনের মধ্যে, উত্তর গোলার্ধে এই দিনটি হয় বছরের সবচেয়ে দীর্ঘতম দিন ও সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত রাত, এবং এটি গ্রীষ্মের আনুষ্ঠানিক সূচনা নির্দেশ করে।ভূগোলের পরিভাষায় একে বলে উত্তরায়ণ।
এই সময়, নিরক্ষরেখার সাপেক্ষে পৃথিবীর উত্তর অংশ সূর্যের দিকে সবচেয়ে বেশি হেলে থাকে, যার ফলে সূর্য আকাশে সবচেয়ে উঁচু ও দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে। “Solstice” শব্দটি লাতিন শব্দ “sol” (সূর্য) এবং “sistere” (স্থির থাকা) থেকে এসেছে, কারণ এই দিনে সূর্য যেন আকাশে এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২১শে জুন সুর্যরশ্মি কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর কিরণ দেয়, আরও ভালোকরে বললে বলা যায় উত্তর অক্ষাংশের উপর ২৩.৫ডিগ্রী কোণে সুর্যরশ্মি পড়ে।
প্রাচীনকাল থেকেই গ্রীষ্মকালীন অয়নদিবস বিশ্বের নানা সংস্কৃতিতে আনন্দ, প্রাচুর্য ও নতুন সূচনার প্রতীক হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে। মিশরীয়রা পিরামিড এমনভাবে নির্মাণ করেছিল যাতে এই দিনে সূর্য নির্দিষ্ট কক্ষের সঙ্গে সোজাসুজি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। মায়া সভ্যতাও সূর্যের গতিপথ পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করেছিল। ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জে সূর্যোদয় এই দিনে হিল স্টোনের ঠিক উপর দিয়ে দেখা যায়, যা এই মহাকর্ষীয় ঘটনার গুরুত্বকে নির্দেশ করে।
উত্তর ইউরোপে, বিশেষত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে, এই দিনটি “মিডসামার” হিসেবে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়। সেখানে ফুলের মালা পরে নৃত্য, গান, আগুন প্রজ্বালন ও উৎসবের মাধ্যমে প্রকৃতির প্রাচুর্য ও জীবনের উদযাপন করা হয়।
এটি কেবল ঐতিহ্য বা ধর্মীয় উপলক্ষ নয়, বরং বৈজ্ঞানিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবী তার অক্ষের ওপর প্রায় ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে হেলে ঘোরে, যা ঋতু পরিবর্তনের মূল কারণ। উত্তরায়ণ উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে সরাসরি সূর্যালোক পড়ে এবং তারপর ধীরে ধীরে দিনের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে, যা শরৎ ও শীতের সূচনার দিক নির্দেশ করে।
গ্রীষ্মকালীন অয়নদিবস আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ, জীবনের গতি ও নতুন সূচনার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি নতুন লক্ষ্য স্থির করার, আত্মবিশ্বাসে এগিয়ে যাওয়ার এবং জীবনের প্রতিটি নতুন দিনকে উদযাপন করার একটি অনন্য উপলক্ষ।