উদ্বেগের চাক্ষুষ মানচিত্র

উদ্বেগের চাক্ষুষ মানচিত্র

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

আমরা সবাই কখনও না কখনও সেই অদ্ভুত অস্বস্তিটা অনুভব করেছি যখন যেভাবেই সিদ্ধান্ত নিই, কিছু একটা ভুল হবেই। তখন মস্তিষ্কে ভারি একটা চাপ কাজ করে। এই মানসিক অবস্থাকেই বলে উদ্বেগ।এতদিন এ ছিল অদৃশ্য, কেবল অনুভবের বিষয়। কিন্তু এবার বিজ্ঞানীরা সত্যিই দেখে ফেললেন উদ্বেগকে।এধরণের পরিস্থিতির উদ্রেক হলে মস্তিষ্কের ভেতর ঠিক সেই মুহূর্তে কি ঘটে চলে তার সাক্ষাৎ বাস্তবচিত্র ফুটিয়ে তুললেন।
এই অসাধারণ গবেষণাটি করেছেন ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা এমন এক ভিডিও গেম তৈরি করেছেন, যা মস্তিষ্কের ভিতরের উদ্বেগের ঝড়কে ধরতে পারে। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা কম্পিউটারের খেলার কাঠি ( জয়স্টিক) ব্যবহার করে বিপজ্জনক বস্তু এড়ানোর চেষ্টা করে। কখনো সহজ, কখনো আবার এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যেখানে যেভাবেই চলুক ক্ষতি অনিবার্য। এটিকেই বলা হয়, “অনিবার্য পরাজয় পরিস্থিতি ” বা “শুধু সংঘাত এড়িয়ে চলা ”। এটি বাস্তব জীবনের উদ্বেগের সঙ্গে মিলে যায়। আর এই সময়েই মস্তিষ্কে শুরু হয় উদ্বেগের আসল নাটক।
১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪০ জন তরুণ-তরুণীকে দিয়ে এই গেম খেলানো হয়,তাদের মাথায় লাগানো হয় ইইজি সেন্সর। এই সেন্সরটি মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সংকেত ধরতে পারে বা বলা ভালো এটি মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ তরঙ্গের এক মানচিত্র। ফলাফল ছিল চোখধাঁধানো। যখন পরিস্থিতি কঠিন হয়, তখন মস্তিষ্কের ডান দিকের সামনের অংশে থিটা তরঙ্গ তীব্রভাবে সক্রিয় হয়। গবেষণার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই থিটা তরঙ্গ মস্তিষ্কের যৌক্তিক ও আবেগ ঘটিত অংশগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন এই সংযোগ অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়ে। ফলে মস্তিষ্ক একদিকে কাজ করতে চায়, অন্যদিকে অচল হয়ে যায়।
গবেষক বেনজামিন স্টকার আগে চিকিৎসা ক্ষেত্রে কাজ করতে করতে উদ্বেগের এই গভীরতা বুঝেছিলেন। তিনি বলেন, “এই প্রথম উদ্বেগকে স্বচক্ষে দেখলাম। এতদিন আমরা শুধু শুনতাম কেউ উদ্বিগ্ন, এখন আমরা তা সত্যিই দেখতে পাচ্ছি।”
গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের অ্যান্টিরিওর সিঙ্গুলেট কর্টেক্স মানসিক কষ্ট ও ভুল শনাক্ত করে।আর ডরসোল্যাটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। এই দুইয়ের ভারসাম্য নষ্ট হলেই উদ্বেগ বাড়ে। মস্তিষ্ক তখন টের পায় যে কিছু একটা করতে হবে, কিন্তু ভয় ও অনিশ্চয়তায় স্থবির হয়ে যায় ।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, ইইজি উপাত্ত প্রমাণ করেছে যে মস্তিষ্ক শুধু উদ্বেগে প্রতিক্রিয়া দেয় না, বরং তা আগেভাগে সেটা অনুমানও করতে পারে।ভবিষ্যৎ বিপদের আশঙ্কাই মস্তিষ্কে উদ্বেগের আগুন জ্বালায়। এবং বিশেষত সে কারণেই উদ্বেগের ঘনঘটা ঘটতে থাকে।
ড. রজার মুর ও টম লকহার্ট-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই গবেষণা ভবিষ্যতে উদ্বেগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। বিজ্ঞানীদের আশা , একদিন হয়তো ছোট একটি ইইজি যন্ত্রকৌশল দিয়েই অল্প খরচে, দ্রুত নির্ভুলভাবে বোঝা যাবে কারও উদ্বেগজনিত সমস্যা আছে কিনা।

সূত্র: EEG theta and alpha biomarkers during an avoid-avoid conflict task: Links to anxiety by Benjamin Stocker, Roger Moore, Tom Lockhart,et.al; published in the International Journal of Psychophysiology,(15.10.2025).
https://doi.org/10.1016/j.ijpsycho.2025.113237

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 + thirteen =