‘আমি যেই দিকেতে চাই, দেখে অবাক বনে যাই,
আমি অর্থ কোনও খুঁজে নাহি পাইরে’।
ভাই রে, ভাই রে।
চারিদিকে জলের রাশি, গাছগুলোকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে, পরক্ষণেই উত্তাল জলের অফুরন্ত ভাণ্ডার নিমেষে কোথাও যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে যে গাছগুলো জলে ডুবে ছিল, সেগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সুন্দরবনকে দেখলে এরকম অবাক হতে হয়, যে দিকে তাকাবেন সে দিকেই অবাক হওয়ার পালা, অর্থ খোঁজা তো দূর অস্ত।
আরও অবাক হতে হয়, জোয়ারের জলের এগিয়ে যাওয়ার পথে পথে ভিন্ন ভিন্ন গাছ-গাছালির বৈচিত্র্য। কেউ বেশি লবণ, কেউ মাঝারি লবণ, কেউ আবার একেবারে কম লবণ সহ্য করতে পারে। সমুদ্রের কাছাকাছি যারা থাকে, সাধারণত তারা বেশি লবণ সহ্য করে, যারা সাগর থেকে দূরে, ক্রমশঃ তারা কম লবণে জন্মায়।
আগে যে সমস্ত গাছের আলোচনা হয়েছে, তারা সবাই ম্যানগ্রোভ। তাছাড়াও আরও অনেক গাছ-গাছালি সুন্দরবনে আছে। এই সমস্ত গাছ-গাছালির কপালে ম্যানগ্রোভের স্বীকৃতি জোটে নি। এরা হালকা লবণ যুক্ত মাটিতে জন্মায়, লবণ ছাড়া জায়গায় ও জন্মাতে পারে। ম্যানগ্রোভ হওয়ার জন্য যে সব অভিযোজিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দরকার, তা এদের মধ্যে কম দেখা যায়। এই গাছ-গাছালিদেরকে দুই ভাবে শ্রেনিবিন্যাস করা যায়। ১) লতা-গুল্ম গাছ-গাছালি, ২) বৃক্ষ জাতীয় গাছ।
১) লতা-গুল্ম গাছ-গাছালি
অতিরিক্ত লবণ শরীরে এলে এরা পাতায় তা রেখে দেয়। তাই এদের পাতাগুলো রসাল এবং মোটা। এদের কাণ্ড এবং মূল খুবই দুর্বল। বিভিন্ন গাছের এক এক ধরনের ফুল ফোটে। গাছগুলো একেবারে আকর্ষণীয় নয়। এই গুলোকে একসঙ্গে ‘লবণপ্রেমী’ গাছগাছালি বলে। এদের নামগুলো সুন্দরবনের গাছ-গাছালিতে এক বৈচিত্র্য এনেছে – লতা হরগজা, লতা সুন্দরী, বনলেবু, সিংরি লতা, বালিলতা, নাটা, চুলিয়া কাঁটা, পানলতা, নাওলতা, বাওলি লতা, বাওলি লতিকা, অম্বরভেল, সুখদর্শন, গিরিয়াশাক, গিরেশাক, নোনা হাতিশুঁড়, ছাগলকুঁড়ি, গদাবানি, বনজুঁই, নোনাশাক, লতা গুড়বেগুন, ও কেরলি। তাছাড়া মান্দা ও
বড়মান্দা হল পরভোজী।
২) বৃক্ষ জাতীয় গাছ
এদের কাণ্ড শক্ত, গুঁড়ি হয়, মূল মাটির গভীরে অনেকখানি যায়, ডালপালায় ভর্তি। এদের দৃশ্য আছে, যেহেতু মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরা লবণ জায়গায় ও লবণ ছাড়া জায়গায় জন্মাতে পারে। অনেক বিজ্ঞানী এদেরকে সহকারী ম্যানগ্রোভ বলে থাকেন। এদের নামগুলো জানা যাক- ভোলা, পরশ, সিংগার, করঞ্জ, বনঝাউ, হিজল, গোরসিঙ্গারা, কেয়া, আমুরা, এবং বুনো আম। এরা সবাই সুন্দরবনের খুব একটা ভিতরে দেখা যায় না, তাই সুন্দরবনের পরিধিতে এদের আধিক্য। এদেরকে সুন্দরবনের বাইরে ও জন্মাতে দেখা যায়।
সুন্দরবন এক বৈচিত্রে ভরা বনভূমি। গানের কথায় বলা যায় – ‘একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনিত আগে’।
তার সাগরের কল্লোল ছন্দে ছন্দে
সবুজের হিল্লোল বর্ণে আনন্দে।
পাখির কুজনে মন মেতে যায়,
বাঘের ডাকে শিহরণ জাগায়।
হরিণের পাল ধানির ঘাসে,
সদা তাকায় ক্ষণিক ত্রাসে।
বানর আছে গাছের ডালে ,
বাঘের আসা দিচ্ছে বলে।
জলের কুমির নদীর কুলে,
যাচ্ছে চলে হেলে দুলে।
জোয়ারের ভাটায় মোহনার পাড়ে,
কাঁকড়ার দল সারে সারে।
অনেক প্রানের মেলা বসে,
জোয়ার–ভাটার আসে পাশে।
মাছের সারি দলে দলে,
ঘুরে বেড়ায় নদীর জলে।
জেলে মৌলী ঘুরছে হেতায়,
মাছ ও মধুর সন্ধান যেথায়।
জীবনের বৈচিত্র্য প্রানের টানে,
আয়রে তোরা সুন্দরবনে।
এবার মোরা শপথ নেব,
সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখব।
(শেষ)