
নদী হল এ ধরণীর প্রাণসঞ্চারক। সে পাহাড় থেকে সমুদ্রে জল, পলি ও পুষ্টি পৌঁছে দিয়ে বাস্তুতন্ত্র এবং মানবসমাজকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু কিছু নদী কেন সরল পথে প্রবাহিত হয়, আবার কিছু কেন একাধিক শাখায় বিভক্ত হয়—এই প্রশ্নের উত্তর পেতে বিজ্ঞানীরা শত শত বছর চেষ্টা করেছেন। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এর সমাধান পাওয়া গেছে।
গবেষকরা সারা বিশ্বের ৮৪টি নদীর ৩৬ বছরের উপগ্রহ ডেটা (উপাত্ত) বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, নদীর পাড় ক্ষয়ের হার যদি বিপরীত পাড়ে পলি জমার হারের চেয়ে বেশি হয়, তবে সেই নদী ধীরে ধীরে প্রশস্ত হয়ে বিভক্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে, যদি ক্ষয় ও পলি জমা সমান হয়, তবে নদী সরল পথে প্রবাহিত হয়।
নদীর গতিপথ বদলের উপর ভিত্তি করে নদীগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে -একক প্রবাহী এবং বহু প্রবাহী। বিশ্বের অধিকাংশ বড় নদী বহু প্রবাহবিশিষ্ট হলেও উত্তর আমেরিকার দ্বিতীয় দীর্ঘতম মিসিসিপি নদী এর ব্যতিক্রম। গবেষণাটি প্রথম শুরু হয়েছিল মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। সেখানে গবেষকরা দেখেন পলি জমার তুলনায় ক্ষয় বেশি হচ্ছে। প্রকৃতিতে এ ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটে কিনা, সেটা জানার কৌতূহল থেকেই এই গবেষণার সূত্রপাত।
গবেষণায় তারা উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে নদী পাড়ের পরিবর্তন বিশ্লেষণ করতে ‘পার্টিকেল ইমেজ ভেলোসিমেট্রি” প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এতে দেখা যায়, একক প্রবাহী নদীতে ক্ষয় ও পলি সঞ্চয় ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকে, ফলে নদী সরু থাকে। কিন্তু বহুপ্রবাহী নদীতে ক্ষয় বেশি হওয়ায় নদী প্রশস্ত হয়ে একাধিক শাখায় বিভক্ত হয়।
বহুপ্রবাহী নদীর পলি মূলত নদীতলে জমে দ্বীপ তৈরি করে। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে, যেমন ব্রাজিলের সাও ফ্রান্সিস্কো নদীপথ মানবসৃষ্ট বাঁধ ও সেচ প্রকল্পের ফলে পরিবর্তিত হয়েছে।
বিংশ শতকে নগরায়ণ ও কৃষির উন্নয়নের কারণে বহু নদী তার প্লাবনভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হয়েছে, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং নদীর জলতল উঁচু হয়ে বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে। গবেষকরা নদী-পুনরুদ্ধারের জন্য একটি সূত্র তৈরি করেছেন। একটি নদীর প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরে যেতে কত জায়গা ও সময় লাগবে তা নির্ণয় করতে সাহায্য করে সূত্রটি।
আগে যেসব নদীকে আমরা একক প্রবাহী মনে করতাম, হয়তো তারা মূলত বহুপ্রবাহীরই একটা শাখা। ফলে সেটা পুনরুদ্ধারের জন্য ততটা প্রচেষ্টা বা অর্থের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু
একক প্রবাহী নদী পুনরুদ্ধারে বহুপ্রবাহ নদীর তুলনায় দশগুণ বেশি সময় ও জায়গা দরকার। গবেষণাটি থেকে আমাদের নদীগুলির গতিপ্রকৃতি অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে কিভাবে একটা নদীর গতি হঠাৎ পরিবর্তিত হয়, কখন গতি কম হয়, কখন গতি বেশি হয় বা কটা শাখা পরিবর্তন করে, এতে জলবায়ুতে ও মানবজীবনে কি প্রভাব পড়তে পারে – সে সম্পর্কে এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করা সম্ভব হয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ Science Journal (June 2025)