‘এখন’ মানে কিছুই নয়

‘এখন’ মানে কিছুই নয়

প্রদীপ্ত গুপ্তরায়
অধ্যক্ষ, দমদম মতিঝিল কলেজ, কলকাতা
Posted on ১১ মে, ২০২৫

দূরের কোন জায়গায় ‘এখন’ কি ঘটনা ঘটছে? ধরা যাক, কেউ চার আলোকবর্ষ দূরের প্রক্সিমা বি তারার সদ্য আবিষ্কৃত গ্রহে অবস্থান করছে। যদি প্রশ্ন করা হয়, প্রক্সিমা বি তে সে এখন কি করছে?
ভেনিসে থেকে যদি প্রশ্ন করা হয় ‘পিকিংয়ের এখানে কি?’ এই প্রশ্নটার মতোই ওপরের প্রশ্নটার কোন মানেই হয় না। কারণ আমি ভেনিসে থেকে ‘এখানে’-র কথা বলছি, পিকিংয়ের নয়।
ধরা যাক, তোমার বন্ধু পাশের ঘরে আছে, এখন যদি প্রশ্ন করা হয় ‘সে এখন কি করছে?’ এর উত্তরটা অপেক্ষাকৃত সোজা, কারণ তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ আর উত্তরটা দিতে পারবে। কিন্তু সে যদি দূরে থাকে, তুমি তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে, সে ‘এখন’ কি করছে? তুমি যদি তার ছবি দেখ, তাহলে তার ছবি আসতে কিছু ন্যানোসেকেন্ড লাগবে। সে ‘এখন’ কি করছে সেটা তুমি জানতে পারছ না। তুমি যেটা জানছ সেটা তার কিছু ন্যানোসেকেন্ড আগের অবস্থা। ঠিক সেইরকমই। ইংল্যান্ড থেকে নিউইয়র্কে ফোন করলে শব্দ আসতে কয়েক মিলিসেকেন্ড সময় লাগে। কাজেই তুমি যেটা বলতে পার, তোমার বন্ধুর কয়েক মিলিসেকেন্ড আগের অবস্থা। খুব উল্লেখযোগ্য তফাৎ হয়তো তেমন কিছু হবে না।
এখন প্রক্সিমা বি তে যিনি আছেন, তাঁর ওখান থেকে তোমার কাছে আলো আসতে চার বছর লাগবে। তুমি যদি তাঁকে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখ আর পাশাপাশি তাঁর সাথে রেডিওর মাধ্যমে যোগাযোগ কর, তাহলে যেটা দেখবে ও শুনবে সেটা তাঁর চার বছর আগের ঘটনা। প্রক্সিমা বি তে ‘এখন’ মানে যেটা তুমি টেলিস্কোপে দেখছ এবং রেডিও তে শুনছ, সেটা নিশ্চয়ই নয়।
তাহলে তুমি হয়ত বলতে পার, ওই ভদ্রলোক ‘এখন’ কি করছেন, সেটা এই মুহূর্ত থেকে চার বছর পরে দেখতে পাবে। কিন্তু এটা কাজ করবে না। চার বছর পরে তুমি যখন তাঁকে টেলিস্কোপে দেখবে, তাঁর সময়ে, হয়ত তিনি পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন (এটাই সবচেয়ে বেশি সম্ভব) এবং হয়ত ভবিষ্যতের দশ পার্থিব বছর পরে। আর ‘এখন’ ভবিষ্যতে থাকে না ……।
হয়ত এটা আমরা করতে পারিঃ দশ বছর আগে ওই ব্যক্তি যখন প্রক্সিমা বি তে যাবার জন্য যাত্রা শুরু করবেন, তিনি সময়ের পরিবর্তন অনুসরণ করার জন্য একটা ক্যালেন্ডার সঙ্গে রাখবেন। আমরা কি এরকমভাবে ভাবতে পারি, ‘এখন’ বলতে আমরা, তাঁর যে মুহুর্তে নথিভুক্ত দশ বছর শেষ হোল, সেটা বুঝব? না, এটাও ঠিক পদ্ধতি না। তিনি হয়ত তাঁর দশ বছরে গিয়ে ফিরে এলেন, কিন্তু এর মাঝে হয়ত তোমার কুড়ি বছর পেরিয়ে গেছে। তাহলে প্রক্সিমা বি র ক্ষেত্রে ‘এখন’ কি?
সত্যি যেটা হোলঃ আমাদের এই ধরনের প্রশ্ন করা ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন।
প্রক্সিমা বি তে এমন কোন বিশেষ মুহূর্ত নেই যেটা এখানে অবস্থিত এবং এখন গঠন করে।
তাহলে প্রক্সিমা বি তে কোন মুহূর্তকে ‘এখন’ বলা যাবে? – এই প্রশ্নের কোন মানে হয় না। এটা যেন এইধরনের একটা প্রশ্নঃ কোন ফুটবল দল বাস্কেটবল বিজয়ী হবে? বা কত টাকা একটা টুনটুনি পাখি উপার্জন করে? এই প্রশ্নগুলো অর্থহীন। ‘বর্তমান’-এর ধারনা আমাদের কাছাকাছি যেসব বস্তু আছে তাদের ওপর আরোপিত হয়, দূরের কোন বস্তুর ক্ষেত্রে না।
আমাদের ‘বর্তমান’ সারা মহাবিশ্ব অব্দি বিস্তৃত না। এটা আমাদের চারপাশে থাকা একটা বুদবুদের মত।
এই বুদবুদকে কতটা বড় হতে পারে? সময় আমরা কত সূক্ষ্মভাবে মাপতে পারি তার ওপরে নির্ভর করে। যদি আমরা সময় ন্যানোসেকেন্ডে মাপি, তাহলে বর্তমান কয়েক মিটার অব্দি বিস্তৃত হবে। আর যদি সময় মিলিসেকেন্ডে হয় তাহলে বর্তমান কয়েকহাজার কিলোমিটার অব্দি হতে পারে। আর আমরা মানুষরা, যারা খুব কষ্ট করে দশ ভাগের একভাগ সেকেন্ড গুনতে পারি, আমাদের কাছে পুরো পৃথিবীটাই এই বুদবুদের মধ্যে পড়ে যায়, যেখানে সবটাই বর্তমান এবং প্রতিটি মুহূর্তই সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। এই অব্দি আমরা যেতে পারি।
আমাদের অতীত আছে। আগে যে সব ঘটনা ঘটেছে তার পরম্পরায় আমরা যা এখন দেখছি। আমাদের ভবিষ্যৎ আছে। এখন এবং এখানে আমরা যে ঘটনা দেখার পরে যা কিছু ঘটবে বা ঘটতে পারে। অতীত এবং ভবিষ্যতের মাঝে একটা মধ্যবর্তী সময় আছে যেটা অতীত বা ভবিষ্যৎ কোনটাই নয় কিন্তু তার একটা ব্যাপ্তি আছে; মঙ্গলগ্রহে পনেরো মিনিট; প্রক্সিমা বি তে আট বছর; এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে কয়েক লক্ষ বছর। এগুলোকে প্রসারিত বর্তমান বলা যেতে পারে। আর এটাই বোধহয় আইনস্টাইনের অদ্ভুত এবং সবচেয়ে বড় আবিষ্কার।
মহাবিশ্বে একটা ভালভাবে সংজ্ঞায়িত ‘এখন’ একটা বিভ্রম, আমাদের অভিজ্ঞতার অবৈধ বহিঃপ্রকাশ। ঠিক সেইরকমই ‘মহাবিশ্বের বর্তমান’ অর্থহীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

9 − 5 =