বৃষ্টি, বৃষ্টি, বৃষ্টি।
সবে বীজতলা থেকে ধানের চারা মাঠে লাগিয়েছিলেন চাষী। পুরো মাঠ এক কোমর জলের তলায়। ধানের চারা আর দেখা যাচ্ছে না। মাঠে সার দিয়ে ট্রাক্টর চালানো হয়েছিল। মহাজনের থেকে ধার করে কেনা সার দলে গেল।
বষ্টিতো শুধু এ তল্লাটে নয়! বৃষ্টি হচ্ছে পূর্ব ভারত জুড়েই। ঝাড়খন্ড থেকে নেমে আসা জলের ধাক্কায় সব জলাধার টইটম্বুর। বাঁধ বাঁচাতে তাই খুলে দেওয়া হয়েছে গেট। বাঁকুড়া, বীরভূমের মতো আপাত-সুখা জেলায় নদী উপচে প্লাবিত হয়েছে বহু গ্রাম। দ্বারকেশ্বর, দামোদর, বক্রেশ্বর, সুবর্ণরেখা, অজয়, ময়ুরাক্ষী- সব নদীর জল উপচে পড়ে গ্রাস করেছে লোকালয়। পুকুর, নদী আর মাঠের ব্যবধান ঘুচেছে।
অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পরে বঙ্গোপসাগরে একের পর নিম্নচাপ তৈরি হওয়াতেই এই অবিরাম বর্ষণে বলে জানাচ্ছেন আবহবিদেরা। আবহবিদদেরা বলছেন, জুন-জুলাই-অগস্টে আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরে পরপর নিম্নচাপই বর্ষাকে ঠেলে ভিতরের দিকে অর্থাৎ বিদর্ভ, মধ্য মহারাষ্ট্র ও মধ্য ভারতের দিকে পাঠিয়ে দেয়। এবার সেই নিম্নচাপের ভারসাম্যটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আরব সাগরের তুলনায় অনেক বেশি নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। সেটাই অতিবৃষ্টিতে প্লাবন ঠেকে এনেছে পূর্ব ভারতে।
কেন এবার বেশি নিম্নচাপ তৈরি হল বঙ্গোপসাগরে? আরব সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরের জলের উষ্ণতা বেশি থাকাতেই কি এ বার বেশি বৃষ্টি পাচ্ছে গাঙ্গেয় বঙ্গ? বিশেষ করে জুন এবং জুলাই মাসে দক্ষিণবঙ্গে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তাতে এই প্রশ্নই বেশি করে উঠছে।
আবহাওয়া দফতরের হিসেবে, ১ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গে স্বাভাবিকের তুলনায় ৩৪ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তার পিছনে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া নিম্নচাপগুলিকেই দায়ী করছেন আবহবিজ্ঞানীরা। সর্বশেষ যে নিম্নচাপটি বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়েছিল তার জন্য ২৭-৩০ জুলাইয়ের মধ্যে দক্ষিণবঙ্গে ৩১৯ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। আবহবিদদের একাংশের মতে, সাগরের জলের উষ্ণতা বেশি থাকলেই নিম্নচাপ তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, গরম জল থেকে বাষ্প সংগ্রহ করে তা শক্তিও বাড়ায়। সেখান থেকেই বঙ্গোপসাগরের জলের উষ্ণতা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। উল্লেখ্য, বর্ষার পূর্বাভাসেও মৌসম ভবন জানিয়েছিল, এ বার আরব সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরের উষ্ণতা বেশি থাকতে পারে।
আবহবিদেরা জানান, ভারতে বর্ষার উপরে আরব সাগর ও বঙ্গোপাসাগরের উষ্ণতাজনিত দড়ি টানাটানি চলে। এর ফলেই কোন এলাকায় কত বৃষ্টি হবে তা নির্ভর করে। যদি আরব সাগর বেশি উষ্ণ হয় তাকে বলা হয় পজ়িটিভ ইন্ডিয়ান ওশেন ডাইপোল। আর আরব সাগরের তাপমাত্রা তুলনায় কম হলে বলা হয় নেগেটিভ ইন্ডিয়ান ওশেন ডাইপোল।
প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছর জুন মাসে গাঙ্গেয় বঙ্গে সে ভাবে বৃষ্টি মেলেনি। তার ফলে জুন মাস মোটের উপরে শুকনো কাটছিল। এ বার দেখা গিয়েছে, জুন মাসে লাগাতার বৃষ্টিই শুধু হয়নি, একেবারে উদ্বৃত্ত বর্ষা হয়েছে। জুলাইয়েও বহু দিন সে ভাবে বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু নিম্নচাপের ধাক্কায় অল্প সময়ে অতিবৃষ্টি হয়েছে। আবহবিদদের অনেকের মতে, উষ্ণ বঙ্গোপসাগরের দাক্ষিণ্যে গাঙ্গেয় বঙ্গ উদ্বৃত্ত বর্ষা পেলেও বর্ষার স্বাভাবিক ছন্দ বজায় থাকছে কি না, তা নিয়েও গবেষণা প্রয়োজন।