উৎসে ফেরার সহজাত প্রবৃত্তি
কেন এমন কথা বলছি?! তাহলে একবার বরং এনাড্রোমাস সামোন মাছের গল্প বলি, যারা সমুদ্র থেকে মিষ্টি জলের নদীতে চলেছে জীবনের এক পরম দায়িত্ব পালনের তাগিদে। হাজারে হাজারে সামোন মাছ আছড়ে পড়ছে কানাডার তীব্রস্রোতা শীতল জলধারার পাথুরে বুকে। প্রশান্ত মহাসাগর ছেড়ে নদীর মুখে চলার শুরু মানে অবশ্যই এদের পছন্দসই সামুদ্রিক খাবার ফেলে বেরিয়ে পড়া। নদীর উজান বেয়ে অনিশ্চয়তা আর প্রতিকূলতার বাধা পেরিয়ে এইসব সামন কয়েকশো কিলোমিটার সাঁতরে পৌঁছে যাবে ঠিক নিজের জন্মস্থানটিতে। ফিরতি সফরের সেই চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রজননের কাজটি সফল ভাবে সমাপ্ত করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।।
মিষ্টি জলে সাঁতরে চলার সময় এদের পেটে হাজার হাজার জনন কোষ পরিণত হতে শুরু করে, অথচ এই সময় এরা সম্পূর্ণ উপবাসী। নিজস্ব প্রজনন স্থলে পৌঁছে মেয়ে মাছ যখন অগভীর জলের তলায় নুড়ির বিছানা সরিয়ে ডিম্বাণু রাখে, পুরুষ মাছ ঠিক তখনই তার ওপর শুক্রাণু বৃষ্টি করার চেষ্টা করে। এদের এই যুগলবন্দীতে এক একটা জলীয় প্রজনন ক্ষেত্রে প্রায় আলোকবর্ষ পরিমাণ মাছের ছানা জন্মানোর সম্ভাবনা তৈরি হয় তবে প্রকৃতির নিয়মে পরিপূর্ণ রূপে বাঁচার সৌভাগ্য হয় তাদের ভগ্নাংশ খানিকের (বেশির ভাগ সময় এক শতাংশেরও কম)।
জীবের প্রধান কাজ তার নিজের প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখা। প্রাকৃতিক নিয়মের চাকায় বাঁধা প্রতিটি জীব জীবনের এই পরম উদ্দেশ্য পূর্ণ করার একটি যন্ত্র মাত্র। প্রজননের কাজ শেষ হতে হতে সামোন বাবা মা অবশ্যই ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত। অবশেষে অভুক্ত আর কাহিল মাছেদের ঝাঁকে ঝাঁকে মৃত্যুর পালা। অথচ এই যবনিকা পতনও নদীকে আরো কিছু দিয়ে যাবার এক অনন্য প্রক্রিয়া। সমুদ্রে লালিত ও বড় হওয়া মাছেরা শীতের মরশুমে তাদের শরীরের সবটুকু মিষ্টি জলের জীবদের ভরণপোষণের জন্য বারবার বিলিয়ে দিয়ে নদীর বাস্তুতন্ত্রকে সুস্থ ও প্রাণবন্ত করে যায়।
মা বাবার অবর্তমানে এদের বাচ্চারা নদীতে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। শীতের শেষে সবাই পাড়ি দেয় সাগর সন্ধানে, তবে কিছু মাছ একটি বছর জন্মস্থানে রয়ে যেতেও পারে। মোহনায় এসে প্রথম লবণাক্ত জলের স্বাদ পায় তারা। বেশ কিছুটা সময় সেখানে কাটিয়ে শেষে একেবারে বেরিয়ে পড়ে অতল সমুদ্রের আঙিনায়। সেখানে থাকার সময়কাল বা বড় হওয়ার হার সব প্রজাতির সমান নয়। তবে তারা সবাই ফিরবে ওই একই নদীর টানে, হাজার হাজার মাইল ঘুরে আসার পর। এ এক আশ্চর্য কাহিনী তো বটেই।
আটল্যান্টিকবাসী সামোনরাও একই রকম ফিলোপ্যাট্রিক, তবে তাদের ক্ষেত্রে প্রজনন ক্ষেত্র গুলির অবস্থান অবশ্যই আলাদা। তারা এই মহাসমুদ্রের দুদিকে দুই মহাদেশের নদীতেই নিজেদের জায়গা রেখেছে, পূর্ব দিকে ইউরোপ আর পশ্চিমে আমেরিকা। জন্মের দু-চার বছর পর একবার লোনা জলে পৌঁছে প্রায় বছর তিনেক তারা আর নদীমুখো হয় না। আটল্যান্টিক সামোন প্রজননের পর সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার ক্ষমতাও রাখে, তাই প্রাকৃতিক ভাবে এদের আয়ু লম্বা।
দিকভ্রান্ত না হয়ে লক্ষ্যে ফিরে আসার এই অনবদ্য ক্ষমতায় এরা অনেক উন্নত। পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রকে অনুসরণ করে, আর শক্তিশালী ঘ্রাণশক্তিকে হাতিয়ার করে এরা সেই একই নদীতে, তার ঠিক সেই শাখায় উপস্থিত হয় যেখানে তাদের জন্ম হয়েছিল। জন্মস্থানের প্রতি এই নাড়ির টান সামোন ছাড়াও দেখা যায় সামুদ্রিক কচ্ছপদের মধ্যে। জীব বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয়েছে natal philopatry/ন্যাটাল ফিলোপ্যাট্রি।
মানুষ সামোনের এই সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি চিরকাল উদাসীন। এখান ওখান নদীতে বাঁধ দিয়ে এদের উজানে আসা এখন অনেক সীমিত। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে শুধু কলম্বিয়া নদীতেই প্রায় দুশো জায়গায় সামোনের বাসা ছিল, তার মধ্যে ঊনসত্তরটি জায়গায় তারা আর আসে না। সুইডেনে চল্লিশের বেশি জলধারায় সামোনের ক্রীড়াক্ষেত্র ছিল, এখন সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দশ থেকে বারো। এমনকি কিছু জায়গায় সামোনের দল বাঁধের পেছনেই বাধা পড়ে গেছে, তাদের সমুদ্রে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। পরে বাঁধ ভেঙে দেওয়ার পরীক্ষা করেও দেখা গেছে দীর্ঘ দিন, বরং বলা যায় কয়েক প্রজন্ম, মিষ্টি জলে বাস করে তারা লোনা জলের দিকে যাওয়ার নেশাই খুইয়ে ফেলেছে। অথচ মানুষের সামোন ধরার ও খাওয়ার নেশায় এতটুকু ঘাটতি হয়নি। আজও কলম্বিয়া নদীতে অগাস্ট থেকে ডিসেম্বর সামোন ধরার উৎসব চলে। অবশ্য সেটা বিশেষ ধরনের ছিপ ফেলে ধরতে হয়, যাতে তাদের গলায় ক্ষতি না হয়। ষোল ইঞ্চির থেকে ছোট সাইজের মাছকে জলে ছেড়ে দেওয়ার নিয়ম। একজন দিনে দুটির বেশি মাছ ধরাও নিষিদ্ধ।
আজ ওরেগন রাজ্য শুধু এইসব নিয়মকানুন বানিয়েছে তা নয়, সেসব বাস্তবায়িত করার জন্য তারা প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের দেশ কখনও এমনটার ধারে কাছেও আসতে পারবে কি না তা যথেষ্ট সন্দেহের ব্যাপার। আমাদের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো জীব ও পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে অত্যন্ত নির্বিকার। তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা আসা বড়ই প্রয়োজন।
*ক্যাটাড্রোমাস মাছ উল্টো পথের পথিক। মিষ্টি জলে বাস করলেও এদের প্রজনন স্থল সমুদ্র। বাচ্চারা সেখান থেকে নদীতে ফিরে আসে।
( শেষ)