সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এক আশ্চর্য আলোক-ভিত্তিক চিকিৎসা তৈরি করেছেন। এটি সূর্যের আলোর বদলে কৃত্রিম এল ই ডি আলোর শক্তি ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষকে নিশানা করে নিঃশেষ করতে পারে, আশপাশের সুস্থ কোষগুলোর বিন্দুমাত্র ক্ষতি না করেই।
এই অসাধারণ সাফল্য এসেছে অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় এবং পোর্তুগালের পোর্তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণায়, যা “ইউ টি অস্টিন পোর্তুগাল প্রোগ্রাম”-এর অঙ্গ। তাঁদের উদ্ভাবিত এই আধুনিক প্রযুক্তি ভবিষ্যতে ক্যান্সার চিকিৎসাকে আরও সহজ, নিরাপদ এবং সবার নাগালে এনে দিতে পারে। এই প্রযুক্তি প্রচলিত কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনের যন্ত্রণাদায়ক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই ক্যান্সার মোকাবিলার এক নতুন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
গবেষকরা এক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন এক অভিনব উপাদান এসএনওএক্স ন্যানোফ্লেকস । যেখানে “Sn” মানে হলো টিন বা স্ট্যানাম। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলো ক্যান্সার কোষে পৌঁছে গেলে এল ই ডি আলোয় সক্রিয় হয়ে সেগুলোকে উত্তপ্ত করে তোলে। উত্তাপ এতটাই সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় যে, ক্যান্সার কোষই মারা যায় কিন্তু আশপাশের সুস্থ কোষ সম্পূর্ণ অক্ষত থাকে।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো লেজার, বিষাক্ত ওষুধ বা কঠিন অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয় না , তাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই বললেই চলে। ফলে এটি নিরাপদ ও কার্যকর দুই-ই।
প্রকল্পের অন্যতম গবেষক প্রফেসর জিন অ্যান ইনকরভিয়া জানান, তাঁদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি চিকিৎসা প্রণালী উদ্ভাবন করা যা দক্ষ, নিরাপদ এবং সহজলভ্য। তাঁরা আশা রাখেন ব্যয়বহুল লেজার যন্ত্রপাতি বা বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রয়োজন না থাকায় এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারে।
এ সি এস নানো জার্নালে প্রকাশিত এই সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৩০ মিনিটের এল ই ডি আলোক-প্রয়োগে এই পদ্ধতি ত্বকের ক্যান্সার কোষের ৯২% এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সার (বৃহদন্ত্র ও মলদ্বারের ক্যান্সার ) কোষের ৫০% ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সুস্থ মানব ত্বকের কোষে এর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পাওয়া যায়নি। এটা এই প্রযুক্তির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যনির্ধারণ ক্ষমতার প্রমাণ।
এই চিকিৎসা মূলত “নিয়ার-ইনফ্রারেড ফোটোথার্মাল থেরাপি”-র ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি । এই প্রণালীতে আলোর সাহায্যে ক্যান্সার কোষগুলোকে এতটাই উত্তপ্ত করা হয় যে তারা নিজেরাই মারা যায়। এটি অস্ত্রোপচার বা ক্ষতিকর ওষুধের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে।
পোর্তুগালের প্রধান গবেষক আরতুর পিন্টো বলেন তাঁদের লক্ষ্য হলো এমন একটি সহজ, বেদনাহীন, স্বল্পমূল্যের চিকিৎসা তৈরি করা যা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে রোগীরা পেতে পারেন। এল ই ডি আলো ও এসএনওএক্স ন্যানোফ্লেকস একসঙ্গে সেই স্বপ্ন সত্যি করেছে।
বিশেষ করে ত্বকের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে অস্ত্রোপচারের পর একটি ছোট এল ই ডি ডিভাইস ত্বকে স্থাপন করলেই অবশিষ্ট ক্যান্সার কোষ ধ্বংস হবে ঘরে বসেই, সহজে, ব্যথাহীনভাবে। ফলে পুনরায় রোগ ফিরে আসার ঝুঁকিও অনেকটা কমে যাবে।
ক্যান্সার এখনো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ। তাই এটি এমন এক চিকিৎসা প্রণালী, যা আলো ও তাপের মাধ্যমে নির্দিষ্টভাবে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে মানবস্বাস্থ্যের ইতিহাসে ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।
গবেষক দল এখন প্রযুক্তিটিকে আরও উন্নত করতে চায় । তাঁরা বিভিন্ন নতুন উপাদান পরীক্ষা করছেন এবং এমন সুবহ যন্ত্র তৈরি করছেন, যা ঘরোয়া চিকিৎসাতেও ব্যবহার করা যাবে।
সূত্র : “SnOx Nanoflakes as Enhanced Near-Infrared Photothermal Therapy Agents Synthesized from Electrochemically Oxidized SnS2 Powders” by Hui-Ping Chang, Filipa A. L. S. Silva,et.al;(16.09.2025), ACS Nano.
DOI: 10.1021/acsnano.5c03135
