এ আই-এর শক্তি খিদে

এ আই-এর শক্তি খিদে

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৬ মার্চ, ২০২৫

ভার্জিনিয়ার কুলপেপার কাউন্টি। বড় বড় খামারে ঘেরা আমেরিকার ছোট্ট এক মনোরম শহর। এখানে প্রতি তিনজন মানুষের একটি বাড়িতে অন্তত একটি গরু পাওয়া যাবে। চারিদিক শুধু বিচলি এবং গোবরের গন্ধে ম-ম করে। কাউন্টির বাসিন্দা সংখ্যা ৫৫,০০০। এই গ্রাম্য পরিবেশ একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তনের মাঝেও একই রয়ে গেছে। তবে গত কয়েক বছরে এই কাউন্টি সাতটি বড় তথ্যকেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। এই বিশাল কাঠামোগুলির ভিতরে, কম্পিউটার সার্ভারের সারিগুলি, এ আই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স) দ্বারা পরিচালিত চ্যাট জি পি টি-এর মতো চ্যাটবটের মডেলগুলির প্রশিক্ষণ দিতে সাহায্য করবে। যা দিয়ে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি দৈনিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে। তবে এই নির্মাণকাজ ভার্জিনিয়ার জন্য খুব একটা সুখপ্রদ হবে না। আসলে এই এক-একটি কেন্দ্র, প্রায় দশ হাজার আবাসিক বাড়ির সমান বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করবে। ফলত নিঃসন্দেহে তাদের খরচ বাড়বে। শুধু তো খরচ বাড়াই নয় সব থেকে বড় প্রশ্ন, এলাকায় যা বিদ্যুৎ অবকাঠামো আছে তাকেও বিস্তর চাপের মুখে পড়তে হবে। স্থানীয় বাসিন্দারা এই বিদ্যুত-চাহিদা নিয়ে সতর্ক। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত রাজ্য-নিযুক্ত একটি পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয় যে এই তথ্য কেন্দ্রগুলি অর্থনৈতিক সুবিধা আনবে বটে, কিন্তু কেন্দ্র সংখ্যা বাড়তে থাকলে আগামী দশ বছরের মধ্যে বিদ্যুতের চাহিদা দ্বিগুণ হবে। “বিদ্যুৎ কোথা থেকে আসবে?” প্রশ্ন করেন পিডমন্ট এনভায়রনমেন্টাল কাউন্সিলের কর্মী পারমেলি। ইনি রাজ্যে তথ্যকেন্দ্র সংখ্যা বৃদ্ধির মানচিত্রায়ন করছেন। জবাব আসে, ‘আমরা পাশের জেলা থেকে বিদ্যুৎ কিনব।’ কিন্তু সেই জেলা আবার অন্যের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার পরিকল্পনা করছে। এ আই বা তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কিত অনুরূপ দ্বন্দ্ব বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিচ্ছে। বিশেষত যেখানে কেন্দ্রগুলি রেকর্ড গতিতে গড়ে উঠছে। বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলি সম্মিলিতভাবে তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নতুন তথ্য কেন্দ্র এবং সার্ভারগুলিতে শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করতে উৎসাহী হচ্ছে। বিশ্ব দৃষ্টিকোণ থেকে, ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ চাহিদার উপর এ আই -এর প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম বলে অনুমান করা হলেও আসলে তথ্য কেন্দ্রগুলি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একে অপরের কাছাকাছি তৈরী হচ্ছে, ফলে গুরুতর স্থানীয় প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে ভার্জিনিয়া, কর ছাড় দেওয়ার কারণে তথ্য-প্রযুক্তির কোম্পানিগুলিকে আকৃষ্ট করেছে, ফলে আরও আরও বেশি তারা কেন্দ্রীভবনের সুযোগ নিয়েছে। ভার্জিনিয়ায় ইতিমধ্যেই ৩৪০টি এরকম কেন্দ্র রয়েছে। পারমেলি আরও ১৫৯টি প্রস্তাবিত কেন্দ্র বা বিদ্যমান কেন্দ্রের সম্প্রসারণের মানচিত্র তৈরি করেছেন, যেখানে সেগুলি রাজ্যের বিদ্যুৎ ব্যবহারের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি বিদ্যুৎ খায়। বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে, প্রতিষ্ঠানগুলির এআই সিস্টেমগুলির বিদ্যুৎ চাহিদা সম্পর্কে অস্বচ্ছতা।
তাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঠিক কতটা শক্তি খরচ করতে পারে ! বিস্তারিত পরিসংখ্যান ছাড়াই, গবেষকরা দুইভাবে এ আই -এর শক্তি চাহিদা নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। ২০২৩ সালে, অ্যালেক্স ডে ভ্রিস নামক এক গবেষক, একটি সরবরাহ-শৃঙ্খল পদ্ধতি ব্যবহার করে NVIDIA সার্ভারের একবছরের শক্তি চাহিদা পরীক্ষা করেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে, ডে ভ্রিস অনুমান করেন যে গুগল সার্চে জেনারেটিভ এ আই কার্যকর করতে চার থেকে পাঁচ লক্ষ NVIDIA এ ১০০০ সার্ভার প্রয়োজন হবে। যা বার্ষিক ২৩-২৯ টেরাওয়াট (=ট্রিলিয়ন ওয়াট) ঘন্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে। এ গণনা অনুসারে, প্রতিটি এ আই সার্চ অনুরোধে ৭-৯ ওয়াট ঘন্টা শক্তি লাগবে, যা একটি সাধারণ সার্চের তুলনায় ২৩-৩০ গুণ বেশি। তবে ডে ভ্রিস স্বীকার করেন যে এই গণনাগুলি সবই আন্দাজি। কারণ, তিনি এই গবেষণা তৃতীয় পক্ষের অনুমানের উপর নির্ভর করে চালাচ্ছিলেন। আধুনিক মডেলগুলি আরও দক্ষ হওয়ায় এই খরচ-মাত্রা এখন সম্ভবত কম। এ আই-এর শক্তি চাহিদা পরীক্ষা করার অন্য পদ্ধতিতে গবেষকরা কোডকার্বন নামক একটি পাইথন সফটওয়্যার ব্যবহার করেন। হাগিং ফেসের সাশা লুচিওনির গবেষণায় দেখা যায়, কোনো লেখা থেকে ছবি তৈরি করতে গড়ে প্রায় ০.৫ ওয়াট ঘন্টা শক্তি লাগে। আর উল্টোটি করতে শক্তি লাগবে এর চেয়ে কম। তবে এই গবেষণার ফলাফল যথেষ্ট নয়। আসলে কোম্পানিগুলি তথ্যকেন্দ্রের শীতলীকরণের শক্তি এবং কিছু বিশেষ চিপের শক্তি ব্যবহারের তথ্য কখনই প্রকাশ করে না। আন্তর্জাতিক এনার্জি এজেন্সির অনুমান, তথ্যকেন্দ্রগুলি বিশ্বের বিদ্যুৎ চাহিদার মাত্র ১-১.৩% ব্যবহার করে। যা ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং ও ডাটা-ট্রান্সমিশন অবকাঠামো সহ ২% হতে পারে। এ আই এর ব্যাপক ব্যবহার, বিদ্যুৎ খরচ বাড়াবে ঠিকই, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে শিল্পের বৈদ্যুতিকরণ, ইলেকট্রিক গাড়ি ও এয়ার কন্ডিশনিংয়ের কারণে বিশ্বের বিদ্যুৎ চাহিদা ৮০% বাড়বে বলে মনে করা হয়। সেই তুলনায় তথ্যকেন্দ্রগুলি তো নেহাত ‘চুনো পুঁটি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − 11 =